দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতির জটিলতা নিরসনে দেশের বিবাদমান প্রধান দুই দল ও জোটের মহাসচিব পর্যায়ে বৈঠক শুরু হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের ব্যক্তিগত তদারকিতে ও তার পাঠানো সংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সরাসরি উদ্যোগ ও দূতিয়ালিতে এই সংলাপ প্রক্রিয়া শুরু হয় গত মঙ্গলবার। এরপর তার উপস্থিতিতে বুধবারও দুই দলের মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতাদের বৈঠক হয়।

দুই বিরুদ্ধ পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসিয়ে দিয়ে আর্জেন্টাইন তারানকো বাংলাদেশ ছাড়েন বুধবার।

তারানকো চলে যাওয়ার পর বিবাদমান দুই দলের মধ্যে পুনরায় কাঙ্খিত সংলাপ বৈঠক আবার হবে কিনা- তা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে দেখা দেয় সন্দেহ। অবশেষে শুক্রবার বিকেলে আবারও দল দুটির মহাসচিবসহ সিনিয়র নেতারা বৈঠকে বসলে সেই সন্দেহ কিছুটা কমে। শুক্রবার বিকেল ৪টায় রাজধানীর গুলশানে ইউএনডিপির একটি প্রজেক্ট অফিসে বৈঠকে বসেন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাদের সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ ও গওহর রিজভী। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান ও ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের মধ্যস্থতাকারী ছিলেন জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী নেল ওয়াকার।

দীর্ঘ প্রায় দুই ঘণ্টার বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, বৈঠকে দুই দল একে অপরকে সুনির্দিষ্ট কিছু লিখিত প্রস্তাব দিয়েছে। তারা এসব প্রস্তাব যার যার দলের প্রধানের কাছে উপস্থাপন করবেন। নিজেদের দলীয় ফোরামে আলোচনা করবেন এবং পরবর্তী করণীয় কৌশল নির্ধারণ করবেন।

জানা গেছে, টানা তৃতীয় দফা বৈঠকে আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতারা আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য পারস্পরিক প্রস্তাব বিনিময় করেছেন।

বৈঠক সূত্র জানায়, বিএনপির পক্ষ থেকে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য দলটি চারটি শর্ত দেয়। এর মধ্যে রয়েছে ঘোষিত তফসিল স্থগিত, আটক নেতাকর্মীদের মুক্তি, দলীয় কার্যালয় অবমুক্তকরণ ও সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। এসব শর্ত মানলে তারা তিনটি ইস্যুতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ফলপ্রসূ সংলাপে বসতে চান। পরিবেশ সৃষ্টি হলে বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ও প্রশাসন নিরপেক্ষকরণ বিষয়েও আলোচনা করবে।

সূত্র আরও জানায়, বিএনপির পক্ষ থেকে বৈঠকে সরকারি দলের কাছে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় গণমাধ্যমে পাঠানো বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়ার দেওয়া দীর্ঘ বিবৃতির লিখিত কপিও তুলে দেওয়া হয়। বিএনপি মনে করে, দলীয় প্রধানের ওই বিবৃতিতে সংলাপ ও সংকট নিরসনে বিএনপির মনোভাব পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার ও জ্বালাও-পোড়াও বন্ধ করলেই সংলাপের পরিবেশ তৈরি হবে বলে বিএনপিকে আশ্বস্ত করা হয়েছে।

শুক্রবার বিকেল ৪ টা ১০ মিনিটে শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৬ টা ১০ মিনিটে শেষ হওয়া ওই বৈঠকে আলোচিত প্রস্তাব সর্ম্পকে জানতে চাইলে দুই পক্ষই মুখে যেন তালা দিয়ে রাখে। বৈঠক শেষে প্রথম বেরিয়ে আসেন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দল। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আলোচনা হয়েছে। ওনারা কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন। আমরাও আমাদের কথা বলেছি। এখন দলের ভেতরে আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’

পরবর্তীতে আবার কবে বসবেন- এমন প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ আশরাফ বলেন, ‘তাদের পয়েন্ট এবং আমাদের পয়েন্ট পর্যালোচনা করে পরবর্তী কৌশল নির্ধারণ করা হবে।’

এর কিছু পরে একই সুরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আমরা বসেছি। তৃতীয় দিনের মতো এই আলোচনা হলো। সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব আমরা দিয়েছি। তারাও তাদের প্রস্তাব দিয়েছেন। এখন দলীয় ফোরামে বৈঠক করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’

গুলশানের ১১০ নম্বর রোডের ১০ নম্বর বাড়িতে ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে, জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মধ্যস্থতায় বৈঠকের সূচনা হয়। শুক্রবার ছিল দুই দলের আনুষ্ঠানিক তৃতীয় দফার বৈঠক।

বৈঠক শেষে বিএনপির প্রতিনিধি দল চলে যান গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে। সেখানে তারা নিজেরা আবার বেশ কিছুক্ষণ বৈঠক করেন। এরপর নেতারা দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে বৈঠকের সার্বিক বিষয় অবহিত করতে তার বাসায় যান। সেখানে খালেদা জিয়া আরও কয়েকজন সিনিয়র নেতার উপস্থিতিতে দীর্ঘ সময় বৈঠক করেন। তারা সরকার পক্ষের দেওয়া প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করেন।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এ প্রসঙ্গে দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার এবং দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। আলোচনার বিষয়বস্তু এই মুহূর্তে গণমাধ্যমে বলা সম্ভব না।’

দলটির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব যা বলেছেন, তার বাইরে আর কিছু বলা এ মুহূর্তে সম্ভব নয়।’

অন্যদিকে, দুই দলের বৈঠক সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতারা দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে আলোচনা করেন। আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘যা হবার সংবিধান অনুযায়ী হবে, সংবিধানের বাইরে কোন কিছুই হবে না।’ বৈঠক সূত্রে এ তথ্য জানা যায়।

(দ্য রিপোর্ট/টিএস-এইউএ-এমএইচ/এমএআর/ডিসেম্বর ১৪, ২০১৩)