জোসনা জামান, দ্য রিপোর্ট : বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভায় উঠছে বাংলাদেশের জন্য প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রস্তাব। আগামী ৩০ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে অবস্থিত সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানা গেছে। অনুমোদনের পরই সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত যোগাযোগ কর্মকর্তা মেহেরিন এ মাহাবুব দ্য রিপোর্টকে জানান, এখন পর্যন্ত (১৪ ডিসেম্বর) বিশ্বব্যাংকের বোর্ড সভার কার্য তালিকায় এ বিষয়টি রয়েছে। যদি কোন কারণে সভাটি পিছিয়ে না যায় তাহলে আশা করছি এ ঋণ সংক্রান্ত প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হবে। বেশ কিছুদিন আগেই আমরা যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ করে ঋণ প্রস্তাবটি ওয়াশিটনে পাঠিয়েছিলাম।

বিশ্বব্যাংক সূত্র জানায়, মিউনিসিপ্যাল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড সার্ভিসেস নামের প্রকল্পের আওতায় এ ঋণের অর্থ ব্যয় করা হবে। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হবে ২ হাজার ৪৭০ কোটি ৯৩ লাখ ৯২ হাজার টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে ১ হাজার ৯৫৩ কোটি ৬৫ লাখ ৩৬ হাজার টাকা, বাকি ৫১৭ কোটি ২৮ লাখ ৫৬ হাজার টাকা সরকারি তহবিল থেকে ব্যয় করা হবে।

বিশ্বব্যাংক সম্পাদিত গ্রোথ স্টাডির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির সম্ভাবনা বেশি, এমন ৫টি মেজর গ্রোথ করিডোর ঢাকা, চট্রগ্রাম, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ এর মধ্যে অবস্থিত পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন এবং দক্ষিণ অঞ্চলের ৩টি জেলা শহরকে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ নগরায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যেই রয়েছে। নগরের জনসংখ্যা ১৯৭৪ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ২৩ শতাংশ হয়েছে এবং ২০১৫ সালে তা বেড়ে ৩৩ শতাংশে বা মোট জনসংখ্যার ৩ ভাগের ১ ভাগ হবে। দ্রুত নগরায়নের মূখে দেশের শহর ও নগরসমূহে অবকাঠামো ও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নানা সমস্যায় জর্জরিত। জীর্ণ অবকাঠামো, অপর্যাপ্ত সুপেয় পানি ও পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা, যানজট, পরিবেশ দূষণ বাংলাদেশের নগরগুলোর স্বাভাবিক চিত্র, যা শহরের উন্নত জীবনযাপনে অন্যতম বাধা। তারপরও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নগরায়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এখন যা প্রয়োজন তা হচ্ছে সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নগরায়ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন, দারিদ্র্য হ্রাস ও উন্নতমানের নাগরিক জীবন নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখতে পারে।

দেশের পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনগুলো আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। যদিও আর্থ-সামাজিক এবং পরিবেশগত নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের শহর এলাকায় দেশের শতকরা ৩০ ভাগ লোক বাস করে। জিডিপিতে যাদের অবদান শতকরা ৬০ ভাগ। শহর এলাকায় শ্রমের উৎপাদনশীলতা গ্রাম এলাকার চেয়ে অনেক বেশি।

এ পরিপ্রেক্ষিতে এর আগে বিশ্বব্যাংক শহর এলাকার মৌলিক নাগরিক সুবিধা প্রদান এবং পৌর প্রতিষ্ঠানের দক্ষতাবৃদ্ধির জন্য মিউনিসিপ্যাল সার্ভিসেস প্রকল্পের মাধ্যমে সহায়তা প্রদান করেছিল। যা ২০১২ সালের ৩০ জুন সমাপ্ত হয়েছে। এ প্রকল্পে রাজশাহী ও খুলনা সিটিকর্পোরেশন এবং ১৭টি পৌরসভা অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাশাপাশি প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় ৪টি বন্যা পরবর্তী পুর্নবাসনের আওতায় ১৫০টি পৌরসভায় সহায়তা প্রদান করা হয়েছিল। এ ছাড়া দেশব্যাপী সিটিকর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য এলজিইডিতে মিউনিসিপ্যাল সাপোর্ট ইউনিট স্থাপনের মাধ্যমে সহায়তা প্রদান করা হয়েছিল। এ সময় বিএমডিএফ নামে একটি ননব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়, যা স্থানীয় পর্যায়ে পৌরসভা এবং সিটিকর্পোরেশনগুলোকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ঋণ দিয়ে সাহায্য করছে।

ওই প্রকল্পের সফলতা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আবারও একটি প্রকল্প নেয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হলে বিশ্বব্যাংক এতে সাড়া দেয়। পরবর্তীতে মিউনিসিপ্যাল গভারন্যান্স সার্ভিসেস প্রকল্পে অর্থায়নের সম্মতি দিয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের বোর্ডে অনুমোদনের পর প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ৪টি নতুন সিটি কর্পোরেশন ২২টি গুরুত্বপূর্ণ পৌরসভা উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া প্রকল্পের মাধ্যমে ১৪৬টি পৌরসভায় ক্যাপাসিটি বিল্ডিং এ্যান্ড ইমপ্লিমেন্টেশন সার্পোট প্রদান করা হবে এবং প্রকল্পের আওতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন জরুরি প্রয়োজনে অতিরিক্ত তহবিল সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে।

এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব ও বিশ্বব্যাংক ডেস্কের প্রধান আরাস্তু খান দ্য রিপোর্টকে জানান, বিশ্বব্যাংকের বোর্ডে অনুমোদনের পর সরকারের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে।

সূত্র জানায়, প্রকল্পটি ৩টি কম্পোনেন্টে বাস্তবায়ন করা হবে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে এটি বাস্তবায়নের কাজ শেষ করবে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।

প্রকল্পটির অবকাঠামো উন্নয়ন সংক্রান্ত কাজ দেশের ৫টি বিভাগের ১৮টি জেলার ২৬ উপজেলা ২৬ পৌরসভা বা সিটি করর্পোরেশনে বাস্তবায়িত হবে। এগুলো হলো- নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন, রংপুর সিটি কর্পোরেশন, কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন, সিলেট সিটি কর্পোরেশন, টাঙ্গাইল পৌরসভা, এলেঙ্গা, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, গোপালগঞ্জ, ভালুকা, ত্রিশাল, মাধবদী, ভৈরব, শেরপুর সৈয়দপুর, গোবিন্দগঞ্জ, দাউদকান্দি, চান্দিনা, চৌদ্দগ্রাম, ফেনী, পটিয়া, মিরেরসরাই, সীতাকুণ্ড, চকরিয়া, শায়েস্তাগঞ্জ এবং মাধবপুর পৌরসভা।

বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে যেসব অবকাঠামো কার্যক্রম বাস্তবায়িত হবে, তা হচ্ছে ৬শ কিলোমিটার আরবান সড়ক উন্নয়ন, ৫৭০ কিলোমিটার ব্রিজ/কালভার্ট নির্মাণ, ১২টি বাস টার্মিনাল, ৪টি ট্রাক টার্মিনাল, ৪টি বোট ল্যান্ডিং জেটি, ৪১০ কিলোমিটার ড্রেনেজ উন্নয়ন, ২৬টি কিচেন মার্কেট তৈরি, ২৬টি হোলসেল মার্কেট, ৩৬টি পাবলিক টয়লেট, ৬টি পার্ক উন্নয়ন এবং ৮টি কমিউনিটি সেন্টার তৈরি করা হবে।

(দি রিপোর্ট/জেজে/রা/এসবি/ডিসেম্বর ১৪, ২০১৩)