মুখোমুখি তিন পক্ষ
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও মহান বিজয় দিবস পালনের পর ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ‘প্রতিহত’ করতে লাগাতfর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছে ১৮ দলীয় জোট। টানা অবরোধ ও হরতালের মতো কর্মসূচির মাধ্যমে দেশে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চায় এই জোট। অন্যদিকে, ১৮ দলীয় জোটের কমর্কাণ্ডকে মোকাবেলা করতে ক্ষমতাসীন দলের তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে।
শুধুমাত্র জোটের শরিক হিসেবেই নয়, দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লার ফাঁসির ‘প্রতিশোধ’ নিতে ও যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত অন্য নেতাদের মুক্তির দাবিতে স্বতন্ত্র কর্মসূচিতে ‘সহিংসতা’ চালাতে পারে জামায়াত-শিবির। কাদের মোল্লার ফাঁসির প্রতিবাদে জামায়াতে ইসলামী রবিবার সারাদেশে হরতাল ডেকেছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, সামনের দিনগুলোতে তিনপক্ষই মুখোমুখী হবে। এতে ‘অনিবার্য’ সহিংসতায় অগণতান্ত্রিক শক্তির উদ্ভব ঘটতে পারে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল এবং ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিলের দাবিতে ১৭ ডিসেম্বর থেকে মাঠে নামছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন এই জোটটি। ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা বক্তব্যের মাধ্যমে বিরোধী জোটের আন্দোলনকে প্রতিহত এবং ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষে বহুবার তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। তবে এবার মৌখিক নির্দেশনাই নয়, দলের হাইকমান্ড থেকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে তৃণমূল নেতাদের। এসময় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির মতো আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পাশে পাবে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা।
দশম জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান দুই দল তথা জোটের মধ্যে কোনো সমাঝোতা না হওয়ায় অনিবার্য সংঘর্ষের দিকে যাচ্ছে দেশ- এমনটি মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সুশীল সমাজ।
আগামী ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিল ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে ১৬ ডিসেম্বরের পর লাগাতর হরতাল-অবরোধসহ কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএনপির একাধিক নেতা এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। আর এসব কর্মসূচি পালনে ‘আত্মগোপনে’ থাকা বিএনপির শীর্ষ নেতারাও মাঠে নামবেন বলে জানা গেছে। এমনকি দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও মাঠের কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারেন।
এদিকে কাদের মোল্লাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি দেওয়ার প্রতিবাদ এবং একই অপরাধে অভিযুক্ত বাকি নেতাদের মুক্তির দাবিতে ‘মরিয়া’ জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির ‘সহিংস’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংগঠন দুটির নেতাকর্মীদের সহিংস প্রতিবাদ এমন আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে।
তবে জামায়াত-শিবির এবং বিরোধী জোটের রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রতিহত করতে জেলা, উপজেলাসহ সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশ দিয়েছে আওয়ামী লীগ।
আন্দোলন কর্মসূচি প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের লক্ষ্যে আলোচনা ও আন্দোলন এক সঙ্গে চলবে। যদি আলোচনার মাধ্যমে কোনো সমাধান না হয় তাহলে আন্দোলনের মাধ্যমেই গণদাবি আদায় করা হবে।’
অন্যদিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের এক আলোচনা সভায় বিরোধী দলের কর্মসূচি প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অনেক ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছি, আর নয়। এখন বিএনপি-জামায়াতের অপশক্তি মোকাবেলা করতে হবে।
দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন-প্রতিআন্দোলন নিয়ে উদ্বিগ্ন দেশের বিশিষ্টজনেরা। এ ব্যাপারে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক পিয়াস করিম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নির্বাচনকে সামনে রেখে দুই দলের দ্বিমুখী নীতির কারণে দেশ অনিবার্য সংঘাতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। একদিকে নিজেদের দাবি আদায়ে বিএনপি ধারাবাহিক অবরোধ কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। এমন কর্মসূচি কার্যত দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল করে দিয়েছে। অন্যদিকে সরকার বিরোধী দলের কর্মসূচিকে প্রতিহত করতে দলের নেতাকর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। এতে সারা দেশে একটি যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। যা গণতন্ত্রের জন্য সুফল বয়ে আনবে না।’
এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশের প্রধান দুই দলের দুই নেত্রী কোনো অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে এগুচ্ছেন না। তাই সমঝোতার কোনো লক্ষণ আপাতত আমরা দেখতে পাচ্ছি না। দেশে যে সঙ্কট চলছে তা মূলত ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে। একদল চায় ক্ষমতায় টিকে থাকতে, আরেক দল চায় ক্ষমতা দখল করতে। আর ক্ষমতার পালাবদলের এই যুদ্ধে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
ইফতেখার আরও বলেন, ‘দুই নেত্রীর অভিন্ন লক্ষ্য না থাকলেও তাদের অন্তত একটি অভিন্ন ঝুঁকি নিয়ে চিন্তা থাকা প্রয়োজন। ২০০৬-০৭ সালের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের অনুধাবন করা উচিত এ ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতি দেশে অগণতান্ত্রিক শক্তির উদ্ভব ঘটাতে পারে। আর যা হবে দুই নেত্রী ও দেশের গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর।’
সঙ্কটময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চলমান সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তা চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিবে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আমীন চৌধুরী।
তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সরকার যেভাবে একতরফাভাবে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের চেষ্টা করছে তাতে বিএনপি নিশ্চুপ থাকবে এমনটি ভাবা ঠিক হবে না। বিএনপি সর্বাত্মকভাবে এই নির্বাচনকে প্রতিহত করার চেষ্টা করবে। আর এজন্য যে কোনো কর্মসূচি তারা দেবে। সহিংসতা এড়িয়ে এসব কর্মসূচি পালন করতে চাইলেও পূর্বেকার অভিজ্ঞতা বলে না যে, তা অসহিংস থাকবে। বিএনপির আগের অবরোধে সারা দেশে বিচ্ছিন্ন সহিংসতা ঘটলেও ঢাকায় তার কোনো ছাপ ছিলো না। কিন্তু গতকাল (শুক্রবার) ঢাকায় জামায়াত-শিবির যে তাণ্ডব চালিয়েছে তাতে ঢাকাও যে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে তা নিশ্চিত।’
তিনি বলেন, ‘সরকার যদি সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ না করে প্রতিহতের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সহিংসতা শেষ হবে না। এতে দেশের মধ্যে চরমপন্থার সৃষ্টি হবে। দেশে বেশ কয়েকটি চরমপন্থী সংগঠন রয়েছে যারা এসব রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে উভয় দলকে সহায়তা করবে। এতে জনগণ বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীকে তাদের নিরাপত্তার জন্য ক্ষমতা গ্রহণের আহ্বান করবে।’
(দ্য রিপোর্ট/এইচআর/নূরু/এইচএসএম/ডিসেম্বর ১৪, ২০১৩)