তারেক সালমান ও মাহমুদুল হাসান, দ্য রিপোর্ট : দুই দলই নিজেদের দাবিতে অনড় থাকায় তিনদফা বৈঠক হলেও কোনো সমঝোতায় আসতে পারেনি বিবাদমান আওয়ামী লীগ-বিএনপি।

বিএনপি চায় প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে হাসিনার পদত্যাগ, আওয়ামী লীগ চায় প্রধানমন্ত্রীর পদে শেখ হাসিনাকে বহাল রেখেই নির্বাচন।

সেক্ষেত্রে সরকারি দল প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা কিছুটা খর্বে রাজি হলেও শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকলে তার নির্বাহী ক্ষমতা যতই সংকুচিত হোক না কেন তা কোন কাজেই আসবে না বলে মনে করছে বিএনপি।

এ অবস্থায় সংলাপ অব্যাহত রাখার বিষয়টিকে শুধু আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই দেখছে বিএনপি। তবে সমঝোতার শেষ চেষ্টা হিসেবে দলের নেতাদের সংলাপ চালিয়ে যেতে তাগিদ দিয়েছেন দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া।

এ ব্যাপারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার ও দেশে অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। আলোচনার বিষয়বস্তু এই মুহূর্তে গণমাধ্যমে বলা সম্ভব না।’

বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট ও সহিংসতায় উদ্বিগ্ন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে আকাঙ্খিত সংলাপ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত মঙ্গলবার বান কি মুনের প্রেরিত জাতিসংঘের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সরাসরি দূতিয়ালীতে প্রথম সংলাপ বৈঠক হয়। এরপর বুধবার ও শুক্রবারও আওয়ামী লীগ-বিএনপির সাধারণ সম্পাদক-মহাসচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে।

সূত্র জানায়, দুদলের বৈঠকে এখনও পর্যন্ত নেতারা সংলাপ ও নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। পারস্পরিক আলোচনার জন্য বিবাদমান দল দুটির নেতারা নিয়মিত বিরতিতে একত্রে আলোচনার টেবিলে বসলে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসতে পারবেন বলে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন।

সূত্র জানায়, দর কষাকষিতে এখনও কঠোর না হলেও ইতোমধ্যেই দুই দলের মূল দাবি সম্পর্কে একে অন্যকে জানিয়ে দিয়েছেন। শুক্রবারের বৈঠকে দল দুটি নিজেদের দাবি ও আলোচনার মূল বিষয়গুলো একে অন্যের সঙ্গে বিনিময়ও করেছে।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত শুক্রবারের বৈঠক শেষে গণমাধ্যমের কাছে তা স্বীকার করেছেন।

সূত্র মতে, নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার সঙ্কট নিরসনে সমঝোতার নমুনা স্বরূপ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করার বিষয়ে কিছুটা নমনীয়তা দেখানো হচ্ছে। বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে নির্দলীয় গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তিকে ওই পদে বসানোর দাবিতে অনড় রয়েছে। আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার পদত্যাগ না করার বিষয়েও অনড় রয়েছে আওয়ামী লীগ।

এদিকে অর্থবহ সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টিতে আটককৃত বিএনপি ও ১৮ দলীয় জোট নেতাদের মুক্তি, হয়রানি ও নির্যাতন বন্ধ, নির্বাচনী তফসিল পেছানো, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ এবং নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির দাবিতেও অনড় রয়েছে বিএনপি। তাদের মতে, দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কারাগারে রেখে সংলাপ অর্থবহ হবে না। আওয়ামী লীগের তরফে আন্দোলনের নামে সংঘাত-সহিংসতা ও নাশকতার কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। তবে সমঝোতার আগে নির্বাচনী তফসিল না পেছানোর পক্ষে মত দিয়ে আওয়ামী লীগ বলেছে, সমঝোতা হলে নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী তফসিল পেছালে তাদের কোনো আপত্তি নেই।

চলমান সংকট নিরসনে দুই দলের মধ্যে সমঝোতার জন্য ঢাকায় আসা জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো বুধবার ঢাকা ত্যাগ করলেও শুক্রবাবের বৈঠক সমন্বয় করেন জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী নেল ওয়াকার।

বৃহস্পতিবার ঢাকা সফরে আসা ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের সিনিয়র প্রতিমন্ত্রী ব্যারোনেস সাইদা ওয়ার্সি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দুই দলের সংলাপকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি সংলাপকে সংকট নিরসনে সমঝোতার শেষ সুযোগ হিসেবেও উল্লেখ করেছেন।

সূত্রে জানায়, শুক্রবার গুলশানের ইউএনডিপির প্রকল্প কার্যালয়ে দুই দলের তৃতীয় দফা সংলাপের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতিনিধি দল নিজ নিজ দলীয় প্রধানের কাছে ছুটে যান। দুই নেত্রীর সঙ্গে দলীয় নেতাদের বৈঠকেও উভয়পক্ষের অনড় অবস্থানই ফুটে উঠেছে।

আওয়ামী লীগ সূত্রগুলো বলছে, গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও নির্দলীয় ব্যক্তিকে প্রধান রেখে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনে বিএনপির প্রস্তাব সম্পর্কে অবহিত করেন দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। রাতে এ নিয়ে দল ও ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে আরেক দফা বৈঠকও করেন হাসিনা। উভয় বৈঠকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও নির্দলীয় ব্যক্তিকে নিয়োগ প্রশ্নে বিএনপির অনড় অবস্থানের কথা তুলে ধরা হয়।

সংলাপ ও সমঝোতার পক্ষে মত ব্যক্ত করলেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সংবিধান মেনেই এমন সমঝোতা হতে হবে। তার পদত্যাগের সুযোগ নেই। কেননা সংবিধানেই স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী কেবল আরেকজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর কাছেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

বিএনপি সম্মত হলে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা খর্ব করে নির্বাচন কমিশনকে আরও অধিক ক্ষমতা প্রদান কিংবা সর্বদলীয় সরকারে এলে বিএনপিকে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানান শেখ হাসিনা।

বিএনপি সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনাকে রাখার ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অনড় মনোভাবের কারণেই সংলাপে কাঙ্খিত অগ্রগতি হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে তিনদফা বৈঠকের পর চেয়ারপারসনের গুলশানের বাসভবনে গিয়ে নেতারা বৈঠকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে খালেদা জিয়াকে অবহিত করেন। এ সময় নেতারা শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী পদে রেখে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলে দলীয় প্রধানের সঙ্গে একমত হন।

এ প্রেক্ষিতে চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে প্রধান দুই জোটের সংলাপ সম্পকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘নির্বাচন নাটক বন্ধ করার জন্যই সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি।’

তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কি একটা খেলা নাকি। জনগণের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এ জন্য আলোচনার প্রয়োজন। সরকারের প্রহসনের নির্বাচনে গণতন্ত্র নস্যাৎ হচ্ছে।’

নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এখনও সময় আছে, নির্বাচন, গণতন্ত্র এবং দেশ এবং জনগণ নিয়ে সরকারের এ খেলা বন্ধ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে চলমান নির্বাচনী নাটক। সবার অংশগ্রহণে অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনের জন্য জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে অর্থবহ আলোচনা করতে হবে সরকারকে। না হলে জনগণ ক্ষমা করবে না।’

বিএনপির সূত্র মতে, শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকলে তার নির্বাহী ক্ষমতা যতই সংকুচিত হোক না কেন তাতে সুষ্ঠু নির্বাচনে কোনো প্রভাব ফেলবে না। এ অবস্থায় সংলাপ অব্যাহত রাখার বিষয়টিকে শুধু আনুষ্ঠানিকতা হিসেবেই দেখছে বিএনপি। তবে সমঝোতার শেষ চেষ্টা হিসেবে দলের নেতাদের সংলাপ চালিয়ে যেতে তাগিদ দিয়েছেন খালেদা জিয়া।

(দ্য রিপোর্ট/টিএস-এমএইচ/এপি/এমডি/ডিসেম্বর ১৫, ২০১৩)