শান্তিতে সমাহিত হলেন ম্যান্ডেলা
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা নিজ গ্রাম কুনুতে চির শান্তিতে সমাহিত হলেন। পরিসমাপ্তি ঘটল ইতিহাসের এক বর্ণিল অধ্যায়ের।
পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা আর নিজ গোত্রের প্রথানুযায়ী রবিবার শেষ বিদায় জানানো হয় রংধনু জাতির স্বপ্নদ্রষ্টাকে।
জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ম্যান্ডেলার শেষকৃত্যানুষ্ঠান। ২১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানানো হয় তাকে।
এরপর ম্যান্ডেলার পারিবারিক মুখপাত্র মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ম্যান্ডেলার চিকিৎসা করার জন্য সেনাবাহিনীর মেডিকেল টিমের প্রশংসা করেন।
শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া ম্যান্ডেলার ঘনিষ্ট বন্ধু আহমেদ কাথ্রাদা জানান, তিনি একজন বড় ভাইকে হারালেন, যিনি অনেক বছর রবেন দ্বীপে তার সঙ্গী ছিলেন।
আবেগাপ্লুত কণ্ঠে কাথ্রাদা বলেন, ‘বিদায় আমার প্রিয় ভাই, আমার পরামর্শদাতা, আমার নেতা।’
ম্যান্ডেলার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গী, আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সদস্য, দীর্ঘদিনের বন্ধু আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের প্রেসিডেন্ট, বিভিন্ন দেশের প্রধানমন্ত্রী, ইরানের ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও প্রিন্স অব ওয়েলসসহ প্রায় সাড়ে চার হাজার মানুষ ম্যান্ডেলার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
শেষকৃত্যানুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন অতিথি নাচ-গানের মাধ্যমে ম্যান্ডেলার বর্ণাঢ্য জীবনকে স্মরণ করেন।
রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে ম্যান্ডেলার গোত্র খোসা আবা টেম্বুর রীতি অনুযায়ী শেষকৃত্যানুষ্ঠান শুরু হয়। এ সময় গান ও কবিতার মাধ্যমে ম্যান্ডেলার জীবন ও অর্জন তুলে ধরা হয়।
এর আগে শনিবার তার লাশ পিতৃভূমি কুনু গ্রামে পৌঁছায়। সেই রাত থেকেই ম্যান্ডেলাকে বিদায় জানানোর শেষ আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
গোত্রের প্রথানুযায়ী একটি ষাঁড় বলি দেওয়া হয়। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠরা সিংহের চামড়া দিয়ে মোড়ানো কফিনটি ঘিরে দাঁড়ান। প্রথানুযায়ী একজন গায়ক ম্যান্ডেলার দীর্ঘ জীবনের বিভিন্ন দিক গানের মাধ্যমে তুলে ধরেন।
গত ৫ ডিসেম্বর জোহানেসবার্গের নিজ বাড়িতে চির বিদায় দেন ম্যান্ডেলা। তার মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী নেমে আসে শোকের ছায়া। সপ্তাহব্যাপী ম্যান্ডেলার স্মরণানুষ্ঠানের আয়োজন করে দক্ষিণ আফ্রিকা।
গত ১০ ডিসেম্বর ম্যান্ডেলাকে শ্রদ্ধা জানাতে জোহানেসবার্গের সকার সিটি স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় এ যাবত কালের সবচেয়ে বড় স্মরণানুষ্ঠানের। বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি থেকে সাধারণ মানুষ অংশ নেন সেই স্মরণানুষ্ঠানে। এরপর সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য ম্যান্ডেলার মৃতদের প্রিটোরিয়ার ইউনিয়ন বিল্ডিংয়ে রাখা হয়। সেখান থেকে প্রিটোরিয়ার ওয়াটারলুফ বিমানঘাঁটিতে নেওয়া হয় মৃতদেহটি। সেখানে ম্যান্ডেলাকে শেষ শ্রদ্ধা জানায় ক্ষমতাসীন আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস। এরপর সামরিক বিমানে করে ম্যান্ডেলার মৃতদেহ মথাথা বিমানবন্দরে নেওয়া হয়।
প্রথানুযায়ী ম্যান্ডেলার নাতি ম্যান্ডলা যাত্রাপথে তার কফিনের সঙ্গে ছিলেন। মথাথা বিমানবন্দর থেকে গার্ড অব অনার দিয়ে সমারিক মর্যাদায় ম্যান্ডেলার মৃতদেহ ৩২ কিলোমিটার দূরে কুনু গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় রাস্তার দুইপাশে দাঁড়িয়ে হাজার হাজার মানুষ ম্যান্ডেলাকে শেষ শ্রদ্ধা জানায়।
সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষে রবিবার জন্মস্থান পাহাড়ঘেরা শান্ত কুনু গ্রামেই শেষ ঠাঁই হয় ইতিহাসের এই মহানায়কের।
ম্যান্ডেলার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো
২০ এপ্রিল, ১৯৬৪
এ দিন নাশতকার অভিযোগে আটক ম্যান্ডেলা প্রিটোরিয়ার সর্বোচ্চ আদালতে আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তার জবানবন্দি দেন।
সেদিন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, ‘আমার সমস্ত জীবন আমি আফ্রিকার মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে উৎসর্গ করেছি। আমি সাদা-কালো সব ধরনের শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। আমি একটি গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের আদর্শ লালন করেছি। যেখানে সব মানুষ শান্তি ও সমান সুযোগ নিয়ে বসবাস করবে। এটা এমন একটা আদর্শ যা অর্জনের জন্যই আমি বেঁচে আছি। এই আদর্শ অর্জনের প্রয়োজন হলে আমি জীবন দিতে প্রস্তুত।’
এর ঠিক দুইমাস পর ম্যান্ডেলাসহ সাতজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০
২৭ বছরের কারাবাস শেষে এ দিন ভিক্টর ভার্সটার কারাগার থেকে ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর ম্যান্ডেলা স্ত্রী উইনির হাত ধরে কারাগার থেকে ধীরে ধীরে হাসিমুখে বের হন। এতো দীর্ঘসময় কারাভোগের পর মুক্তি পাওয়ায় হাজার হাজার জনতা তাকে স্বাগত জানায়। তাকে ঘিরে ধরে শত শত সাংবাদিক। বিশ্বজুড়ে তার মুক্তির দৃশ্য টেলিভিশনের মাধ্যমে সরাসরি দেখানো হয়। অনেক দিন কারাবন্দি থাকায় খুব কম মানুষই তার চেহারা চিনতেন। সে সময় ম্যান্ডেলা জানান, তিনি এ অভ্যর্থনায় অভিভুত।
১০ মে, ১৯৯৪
এ দিন নেলসন ম্যান্ডেলা গণতান্ত্রিকভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন। দেশটির রাজধানী প্রিটোরিয়ার ইউনিয়ন বিল্ডিংয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন তিনি। ঐতিহাসিক এ মুহূর্ত উদযাপন উপলক্ষ্যে এখানে জড়ো হন বিশ্ব নেতা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিরা।
ম্যান্ডেলা তার অভিষেক বক্তব্যে বলেন, ‘আর কখনোই এই সুন্দর দেশে কারও নিপীড়নের অভিজ্ঞতা হবে না। মানবতার যে সূর্য আজ উদিত হয়েছে, তা কখনো অস্তমিত হবে না। ধন্যবাদ।’
২৪ জুন, ১৯৯৫
এ দিন দক্ষিণ আফ্রিকাতে বিশ্বকাপ রাগবির ফাইনাল অনুষ্ঠিত হয়। এ উপলক্ষ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্রান্ড রং পরে ৬০ হাজার মানুষের কাতারে সমাবেত হয়েছিলেন ম্যান্ডেলা। চারিদিকে হাজার হাজার কণ্ঠের ‘নেলসন, নেলসন’ প্রতিধ্বনি প্রমাণ করে দিচ্ছিল ম্যান্ডেলার তুমুল জনপ্রিয়তার।
মাঠে গিয়ে ম্যান্ডেলা দেখলেন কৃষ্ণাঙ্গ দর্শকরা শ্বেতাঙ্গ প্রধান দলের উদ্দেশ্যে দুয়ো ধ্বনি দিচ্ছে। ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার রাগবি দলের অধিনায়ক ফ্রঁসোয়া পিনারকে তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। ফ্রঁসোয়া ধরেই নিলেন, তাকেসহ পুরো দলকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা বলার জন্যই তাকে ডাকা হয়েছে। কিন্তু ম্যান্ডেলা তাকে জানালেন, দলে কোনো পরিবর্তনই আসবে না, বরং তিনি চান ফ্রঁসোয়ার নেতৃত্বে যেন দল রাগবি বিশ্বকাপ জয় করতে পারে।
ম্যান্ডেলা ফ্রঁসোয়াকে ব্রিটিশ কবি উইলিয়াম হেনলির 'ইনভিকটাস' কবিতার উদাহরণ দিয়ে বলেন, 'শুয়ে পড়ার পরিস্থিতিতে সে উঠে দাঁড়াল সোজা হয়ে।’ ভাষায় না বললেও ফ্রঁসোয়া ঠিকই বুঝে নিলেন ম্যান্ডেলার মনের কথা, এই বিশ্বকাপের সময় যদি তারা 'কালোদের' সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয় এবং বিশ্বকাপ জয়লাভ করতে পারে তাহলে হয়তো 'সাদা-কালো'র এত দিনের ভেদাভেদ দূর হয়ে যেতেও পারে। সেদিনই মনে মনে দেশের জন্য বিশ্বকাপ জয়ের প্রতিজ্ঞা করলেন ফ্রঁসোয়া। বিজয়ও ছিনিয়ে আনেন তিনি।
এজন্য এ দিনকে ম্যান্ডেলা তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে দেখেছেন। হলিউডের ক্লিন্ট ইস্টওড এই সত্য ঘটনা নিয়ে ‘ইনভিকটাস’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
১১ জুলাই, ২০১০
ওই বছর বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সকার সিটি স্টেডিয়ামের হাজার হাজার দর্শকের সামনে বিশ্বকাপ ফুটবলের সমাপনী অনুষ্ঠানে হাজির হন নেলসন ম্যান্ডেলা। তবে দর্শকদের উদ্দেশে কিছুই বলেননি তিনি। এটাই ছিল অবিসংবাদিত এ নেতার শেষবারের মতো জনস্মমুখে আসা।
এক নজরে ম্যান্ডেলা
জন্ম: ১৮ জুলাই, ১৯১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ইস্টার্ন কেপ প্রদেশের ট্রান্সেইর মভেসোতে।
পুরো নাম: রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলা
ডাক নাম: মাদিবা
শিক্ষা জীবন: ক্লাকবুরি বোর্ডিং ইনন্সিটিউট, ওয়েসলিয়ান কলেজ, ইউনিভার্সিটি কলেজ অব ফোর্ট হেয়ার, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন, ইউনিভার্সিটি অব উইটওয়ারস্ট্যান্ড।
রাজনৈতিক দল: আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত)
গ্রেফতার: ১৯৬২ সাল।
কারাবাস: ১৯৬৪ সালে রবেন দ্বীপে কারাবাস শুরু।
কারামুক্তি: ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯০ দীর্ঘ ২৭ বছর পর মুক্তি।
মৃত্যু: ৫ ডিসেম্বর ২০১৩।
(দ্য রিপোর্ট/কেএন/এসকে/ডিসেম্বর ১৫, ২০১৩)