‘মননশীল নাটকে দর্শকের অভাব হয় না’
সুদীপ চক্রবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক। এ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নাট্যদলগুলোর সঙ্গে কর্মশালা পরিচালনা, নির্দেশনা ও পরিকল্পনায় তিনি সক্রিয়। গবেষণা করছেন কৃষিভিত্তিক সমাজে চর্চিত হাজার বছরের প্রাচীন দেশজ নাট্যকলা নিয়ে। সুদীপ চক্রবর্তীর সঙ্গে তার কাজ নিয়ে কথা বলেছেন দ্য রিপোর্টের প্রতিবেদক মুহম্মদ আকবর
শেক্সপিয়রের শহর লন্ডনে আপনার নির্দেশনায় তার নাটক সিলেটী বাংলায় মঞ্চায়ন হবে। কেমন লাগছে আপনার ?
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র যুক্তরাজ্য শাখা ২০১৫ সালে লন্ডনের মূলধারার নাট্যমঞ্চে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের একটি নাটক সিলেটী-বাংলা ভাষায় মঞ্চায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এজন্য তাদের আমন্ত্রণে পূর্ব লন্ডনের ব্রিটিশ-বাংলাদেশি নাট্যকর্মী ও নাট্যদলগুলোর সঙ্গে দু’সপ্তাহব্যাপী কর্মশালা পরিচালনা করে নভেম্বরে দেশে ফিরেছি।
আয়োজকরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও ঐতিহ্য যুক্তরাজ্য তথা বহির্বিশ্বের বৃহত্তর পরিসরে উপস্থাপনের লক্ষ্য নিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন আয়োজন করে। এরই ধারাবাহিকতায় এবার বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী রীতিতে সিলেটের আঞ্চলিক উচ্চারণে পাশ্চাত্যের নাটক উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। লন্ডনের স্থানীয় নাট্যকর্মীদের নিয়ে কর্মশালা ও চিন্তা বিনিময়ের জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। আগামী ২০১৫ সালে বৃহত্তর পরিসরে লন্ডনের মূলধারার নাট্যমঞ্চে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের নাটকটি মঞ্চায়ন হবে। শেক্সপিয়রের দেশে আমি তার নাটক নির্দেশনা দেব। কিন্তু বাংলা ভাষায় ও ভাটি-বাংলার পরিবেশনা রীতিতে। এটি আমার জন্য অনেক আনন্দের বিষয়। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও পরিবেশনা শিল্পকলায় দক্ষতার যথার্থ রূপ উপস্থাপনে সচেষ্ট থাকবো।
নাটক নির্দেশনা, কর্মশালা বা এ সংক্রান্ত কাজে আর কোন কোন দেশে গেছেন?
ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার ও নাট্যোৎসবে যোগ দিয়েছি। এর মাধ্যমে নতুন ও ভিন্ন মাত্রার শিল্পরীতির সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে। নাট্য-অভিজ্ঞতায় এই সমৃদ্ধি শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের দেশি ও বিদেশি চিরায়ত ও নতুন নাট্য বিষয়, আঙ্গিক ও উপস্থাপনা রীতিকে নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করার পদ্ধতি ও সূত্র ধরিয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
মান্নান হীরার লেখা এবং আপনার নির্দেশিত মহান মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর এক সংগ্রামী নারীর জীবনের ওপর নির্মিত নাটক ‘লালজমিন’। শুনেছি এটি এ মাসে ৬০তম মঞ্চায়নের পর অনিয়মিত হয়ে যাবে। এর কারণ কী।
একজন কবির লেখা কবিতা কিংবা একজন শিল্পীর আঁকা শিল্পকর্ম বা ছবি বিভিন্ন স্থানে পাওয়া যায়। কিন্তু একজন নাট্যাভিনেতা বা শিল্পীর কাছে মঞ্চই হচ্ছে আসল জায়গা। আর একজন নির্দেশকের কাছে তার নির্দেশিত নাটকটির নিয়মিত মঞ্চায়নই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি গৌরবের। তাছাড়া ‘লালজমিন’ নাটকটি এমন এক বিষয়ের ওপর লেখা যা আমাদের দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, সত্যিকার ইতিহাসের জন্য নিয়মিত মঞ্চায়ন হওয়া খুব প্রয়োজন। দেশে ’৭৫ পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের অপরাজনৈতিক কারণে যেভাবে ইতিহাস বিকৃত হয়েছে এবং হচ্ছে বা এখন কিছুমহল বিকৃত করার চেষ্টা করছে, তা বন্ধ করতে হলে এই ধরনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটকগুলোকে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে দেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও বেশি-বেশি প্রদর্শনী করা প্রয়োজন। কিন্তু এটা অনিয়মিত হবার কারণ বলতে পৃষ্ঠপোষকতার অভাব ছাড়া অন্য কিছু দেখছি না।
শাহ আবদুল করিমের জীবন নিরীক্ষাধর্মী ‘মহাজনের নাও’ নাটকটির ভাষা পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ হওয়ায় এবং সাংস্কৃতিক অভিন্নতা থাকায় খুব ভালোভাবে আত্মস্থ করে মঞ্চে আনতে পেরেছেন। কিন্তু রংপুরের কাহিনী অবলম্বনে সেলিম আল দীন রচিত ‘চাকা’ নাটকটির ভাষা তাদের জীবন উপলব্ধির বিষয়টা কিবে মাথায় নিলেন?
আবদুল করিমের জীবনধর্মী নাটকটি লিখেছেন বিশিষ্ট নাট্যকার ও নির্মাতা শাকুর মজিদ। তাঁর দীর্ঘ গবেষণার ফসল এটি। এ কাহিনী আমার পার্শ্ববর্তী এলাকার হওয়ায় নির্দেশনা দিতে সুবিধা হয়েছে। কারণ এখানকার জীবন জীবিকার সঙ্গে আমি জন্মসূত্রে জড়িত। আর নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন স্যার-এর ‘চাকা’ নাটকটির বিষয় ও সে এলাকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সঙ্গে নিজেকে এবং কুশীলবদের পরিচয় করাতে রংপুর গিয়ে ফিল্ডওয়ার্ক করেছি। ফলে বিষয়টা অনেক সহজ হয়ে গেছে। বোধ করি দর্শকরাও এটি ভালোভাবে নিয়েছে।
ইদানীং অনেকেই বলছেন মঞ্চনাটকের দর্শক কমে গেছে, এ বিষয়ে আপনার মত কি?
আমি দ্বিমত পোষণ করি। কারণ আমার নির্দেশিত নাটক ‘মহাজনের নাও’ কিংবা ‘চাকা’ বার বার মঞ্চায়নের পরও দর্শকের অভাব দেখি না। ‘একশ বস্তা চাল’ কিংবা ‘কঞ্জুস’ নাটকে কী কখনো দর্শকের অভাব দেখেছেন? আমাদের সকলেরই জানা মঞ্চ নাটকের দর্শক একেবারেই সাধারণ কেউ নন। যথেষ্ট জানাশোনা লোক তারা। ফলে নাটকের সঙ্গে তাদের চিন্তার সমন্বয় না ঘটলে তা সুন্দরভাবে গ্রহণ করেন না। তাই আমি মনে করি মননশীল নাটকে দর্শকের অভাব হয় না।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলবেন কি?
বাংলাদেশের জাতীয় নাট্যদল ও পেশাদারির ভিত্তিতে নাট্যচর্চা বিষয়ে গবেষণা করছি।
(দ্য রিপোর্ট/এমএ/নূরু/এইচএস/এইচএসএম/ডিসেম্বর ১৫, ২০১৩)