সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারি নির্দেশ পাচ্ছেন বিএনপি-জামায়াতের জনপ্রতিনিধিরা
বিভিন্ন জেলায় চলমান সহিংসতা ও নাশকতাকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে সরকারদলীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রতিনিধিদের সহিংসতা প্রতিরোধ করতে নির্দেশ দেওয়া হবে।
নির্বাচিত সিটি মেয়র ও কমিশনার, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর চেয়ারম্যান ও কমিশনার, ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা এ নির্দেশ পাবেন।
রবিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এ সিদ্ধান্ত অমান্যকারীরদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সূত্র জানায়, গত ২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে রাজধানীর বাইরে সহিংসতা চরম রূপ নেয়। এ ২২ দিনে পুলিশের গুলিতে অন্তত ৯৬ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীর পাশাপাশি নিরীহ মানুষও রয়েছে। এসব সহিংসতা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশপাশি মাঠ পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদেরও মাঠে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিশেষ করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নাশকতা ও সহিংসতা প্রতিরোধের ব্যাপারে এগিয়ে আসতে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এ নির্দেশ থেকে বাদ পড়ছেন না জামায়াতে ইসলামীর সহস্রাধিক ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যও।
সূত্রমতে, সারা দেশের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার ও গ্রাম পুলিশকে সহিংসতা প্রতিরোধের নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে মাঠপর্যায়ের সবাইকে মনিটরিং করে বিষয়টি দেখভাল করা হবে। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির জনপ্রতিনিধিদেরও নির্দেশ পালনে বাধ্য করা হবে। এ ক্ষেত্রে যারা ব্যর্থ হবে সরকার তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুসারে জামায়াত-বিএনপির জনপ্রতিনিধিরা কাজ করছে কি না তা সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হবে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও জনপ্রতিনিধিরাও সহিংসতা প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের সঙ্গে কাজ করবে।
সূত্র জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের ডাকা অবরোধ এবং হরতালে সারা দেশে ভয়াবহ নাশকতার ঘটনা ঘটেছে। নাশকতা রোধের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন স্থানে গুলি করছে। এতে করে জামায়াতসহ ১৮ দলের নেতাকর্মীরা মারা যাচ্ছে। অনেক স্থানে পুলিশের গুলিতে পথচারীসহ নিরীহ মানুষ গুলিবিদ্ধ হচ্ছে। অন্যদিকে ১৮ দলের অবরোধে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বলা যায়, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।
এদিকে রাজপথে বিক্ষোভের বিরুদ্ধে প্রায়ই মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু সরকার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের কোনো ধরনের জবাবদিহিতার আওতায় আনেনি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে বিক্ষোভ ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা-সম্পর্কিত ৪৮ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত ১৫০ জন নিহত এবং ২ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে অনেক বিক্ষোভকারীকে।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুসারে, মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় দেওয়ার পর সৃষ্টি হওয়া বিক্ষোভে প্রাণহানির ঘটনা শুরু হয়। সর্বশেষ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার পর থেকে রবিবার পর্যন্ত সহিংসতার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।
পরিসংখ্যানে বলা হয়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বোচনের তফসিল ঘোষণার পর ২৬ নভেম্বর থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সহিংসতা চলামান রয়েছে। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের প্রতিবাদে জামায়াতের সহিংসতা। এই ১৭ দিনে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছে ৭১ জন। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ৫৮ জন এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরের ১৩ জন। আহত হয়েছে ৩১৯ জন। এ সময় গুরুতর আহত হয়েছে ১২ জন এবং আহত হয়েছে ২৩৬ পুলিশ সদস্য। পরিসংখ্যানের বাইরে গত ১২ ডিসেম্বরে নিহত ৫ জন, ১৩ ডিসেম্বর নিহত ২ জন, ১৪ ডিসেম্বর নোয়াখালী ও নীলফামারীতে নিহত হয়েছে ১১ জন, ১৫ ডিসেম্বর সারা দেশে মারা গেছে ৭ জন।
রবিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে সারা দেশের এ চিত্র তুলে ধরে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা। তাদের তথ্য অনুসারে, সারা দেশে অন্তত ১০ জেলায় সক্রিয়ভাবে কাজ করছে নাশকতাকারীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীর পাশাপাশি চলমান সহিংসতা প্রতিরোধে জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশ দেওয়ার কথা বলা হয়। প্রয়োজনে তাদের আর্থিকভাবে সার্বিক সহযোগিতাও করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়াও গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশে সরকারিভাবে কিছু নিয়ম বেঁধে দেওয়ার কথা আলোচনা করা হয়েছে বৈঠকে। এর মধ্যে যে সংবাদে দেশবাসী আতঙ্কিত হতে পারে, যে সংবাদে উস্কানি থাকে, গণমাধ্যমে সেসব বিষয় প্রকাশ না করতে বলার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয়ে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কোনো বিফ্রিং করা হয়নি। অবশ্য তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক রাখার বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবস্থা সর্ম্পকে তিনি বলেন, ‘এসব ঘটনা পান্তা ভাত।’
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে দ্য রিপোর্টকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু বলেন, দেশের কয়েকটি স্থানে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। এতে আইনশৃঙ্খলা খারাপের কী আছে। দেশের পরিস্থিতি ভালো।
(দ্য রিপোর্ট/কেজেএন/এইচএসএম/ডিসেম্বর ১৫, ২০১৩)