রাজনৈতিক নাশকতায় আরও ভঙ্গুর হচ্ছে রেল
প্রধান বিরোধী জোটের ধারাবাহিক অবরোধে সর্বাধিক ক্ষতির শিকার হয়েছে সরকারি পরিবহন ব্যবস্থা রেল। লাইন উপড়ে ফেলা, সিগন্যাল লাইট ভাঙা, ফিসপ্লেট খুলে ফেলার মতো নাশকতার শিকার হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই পরিবহন ব্যবস্থাটি। প্রায় দুই দশকেরও অধিক সময় ধরে লোকসানি এই প্রতিষ্ঠানটি চলমান রাজনৈতিক নাশকতায় আরও ভঙ্গুর অবস্থার দিকে যাচ্ছে।
রেল ভবন থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত রেল বন্ধ রাখার ইচ্ছা পোষণ করলেও সরকারের পক্ষ থেকে মিলছে না কোনো সাড়া। তাই মুখ বুজেই রেলের ক্ষতি মেনে নিচ্ছেন রেলের উর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা।
রেল বন্ধের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর মেলেনি রেল ভবন থেকে। রেল ভবন সূত্রে জানা যায়, উচ্চপদস্থ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক ব্যবস্থাপকদের কাছ থেকে রেল বন্ধ রাখার সুপারিশ এলেও তা গ্রাহ্য করছেন না রেলমন্ত্রী।
রেল বন্ধের ব্যাপারে রেল ভবন থেকে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) মো. আমজাদ হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে রেল একটি লোকসানি প্রতিষ্ঠান। রেলকে সাবলম্বী করতে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। রেলের আধুনিকায়নের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সব কিছু ভেস্তে দিচ্ছে চলমান নাশকতা।’
আমজাদ হোসেন বলেন, ‘চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় যদি রেলের উপর নাশকতা বাড়তেই থাকে তাহলে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এমন পর্যায়ে দাঁড়াবে যে, সেখান থেকে রেলকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে দশ বছরেরও বেশি সময় লাগবে।’
রেলের এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘রেলকে সচল রাখতে হলে সকল রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে রেলকে বাইরে রাখতে হবে। রেলকে রক্ষা করা দেশপ্রেমের অংশ, এটা সকল জনগণকে মনে করতে হবে। এভাবে ধারাবাহিক নাশকতার শিকার হতে থাকলে রেল ধ্বংসের দিকে চলে যাবে।’
আমজাদ হোসেন বলেন, ‘রেলকে সচল রাখতে রেলের নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। স্পর্শকাতর ও ঝূঁকিপূর্ণ স্থানগুলো চিহ্নিত করে এসব স্থানে ক্যাম্প করে নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। প্রতিটি ট্রেনের আগে একটি টহল ট্রলি ট্রেন ছাড়া হচ্ছে।’
রেলের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘রেলের নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। রেলের মতো সকল রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে বিচ্ছিন্ন কিছু নাশকতা হতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে ধারাবাহিক টার্গেট করতে হবে রেলকে। এটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা না। এটা যে পরিকল্পিত তা সহজেই বোঝা যায়। যখন কোনো প্রতিষ্ঠান নাশকতার জন্য পরিকল্পিতভাবে টার্গেট হয়, তখন শুধু সরকার নয়, জনগণকেও এগিয়ে আসতে হয় সেটাকে রক্ষার করার জন্য।’
এ ব্যাপারে রেলের ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে কথা বলা হলে জানা যায়, চলমান নাশকতায় রেলের সিডিউলে মারাত্মকভাবে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। নিরাপত্তার বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে কোনো ট্রেন ছাড়া হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবেও বিলম্ব করা হচ্ছে বলে ট্রাফিক বিভাগ থেকে জানা যায়।
রেলের ক্ষতি রোধে কেন রেল বন্ধ রাখা হচ্ছে না এব্যাপারে জানতে চাইলে রেলের ঢাকা জোনের প্রধান নিয়ন্ত্রক মো. জহিরুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘রেল বন্ধ রাখা না রাখা সরকারের সিদ্ধান্ত। রেল বন্ধের ব্যাপারে আমাদের ইচ্ছাও নেই, অনিচ্ছাও নেই। মন্ত্রণালয় ও উচ্চ পর্যায় থেকে যে সিদ্ধান্ত আমাদের জানানো হবে আমরা তাই করবো।’
রেলের উপর ধারাবাহিক নাশকতা ও রেল সচল রাখার ব্যাপারে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও ট্রাস্ট অব ওয়ার্ল্ড ফর বেটার বাংলাদেশের (ডব্লিউবিবি) বিশেষ গবেষক মাহরুফ হোসেন দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য সেবাখাতের মতো রেলও একটি সেবা খাত। চলমান অবরোধে দেশের অধিকাংশ পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ থাকলেও রেলকে সচল রাখার চেষ্টা করছে সরকার। এটা অবশ্যই ভালো লক্ষণ। কিন্তু নাশকতা রোধে সরকার কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে কিনা সেটাও দেখতে হবে।’
মাহরুফ হোসেন বলেন, ‘একদিকে রেল চালু রাখছেন কিন্তু নাশকতা রোধে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না, তখন অবশ্যই রেলের ক্ষতির দিকটা ভাবতে হবে। সরকার যদি রেলের নিরাপত্তা দিতে সমর্থ্ না হয় তাহলে রেল বন্ধ রাখা ছাড়া কোনো বিকল্প আছে বলে আমার জানা নেই। তারপরও আমি চাইবো রেল সচল থাকুক। দেশের সকল পরিবহন ব্যবস্থা অচল হওয়া মানে দেশ অচল হয়ে যাওয়া। যা কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির কাছে কাম্য না।’
তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি রেলের বেশ কিছু পরিকল্পনা রেলকে লাভজনকের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু চলমান রেলের উপর নাশকতা আবারো সেক্টরটিকে ব্যাকফুটে ঠেলে দিবে।’
ধারাবাহিক সহিংসতায় রেলের ক্ষতি : বিরোধী দলের ডাকা হরতাল ও অবরোধে দেশের বিভিন্ন স্থানে রেলের উপর নাশকতা ঘটানো হয়ে। এসব নাশকতায় এপর্যন্ত প্রায় ১৯ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়। তবে রেল ভবন থেকে দেওয়া তথ্য মতে, সিডিউল বিপর্যয়, অবকাঠামোগত ক্ষতি, রেলের কোচ পোড়ানোসহ অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক’শ কোটি টাকা।
রেলের উপর ধারাবাহিক নাশকতার মধ্যে রয়েছে, ৪ ডিসেম্বর গাইবান্ধার সাঘাটায় রেলের ফিসপ্লেট খুলে ফেলায় ট্রেন লাইনচ্যুত হয়ে ৫ জন যাত্রী নিহত এবং আহত হয় আরো ৪০ জন।
এদিকে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া রেল লাইনের নাশকতা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। নাশকতার সম্ভাব্য স্থান হিসেবে ১ হাজার ৪১ পয়েন্ট চিহ্নিত করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। পরবর্তীতে রেলমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে স্পটগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে গণমাধ্যমে অবহিত করেন। এসময় মন্ত্রী জানান, প্রতি রেল ছাড়ার আগে সামনে একটি পেট্রোল টলি ট্রেন ছাড়া হবে। চিহ্নিত প্রতিটি পয়েন্টে ৮জন করে আনসার সদস্য দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা দেওয়া হবে।
এদিকে রেল ভবন থেকে জানা যায়, রেল পুলিশ ছাড়াও পরিস্থিতি বুঝে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্য দিয়েও রেলের নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে।
রেল নিয়ন্ত্রক বরখাস্ত : বৃহস্পতিবার রাতে যুদ্ধাপরাধের অপরাধে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর দেশের রেল চলাচল স্থগিত করা হয়েছে গণমাধ্যমকে এমন তথ্য দেন ঢাকা জোনের রেলের প্রধান নিয়ন্ত্রক (ট্রাফিক) মো. জহিরুল ইসলাম।
দুই ঘণ্টা স্থগিত থাকার পর আবারো রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল করা হয়েছে এমনও তথ্য দেন জহিরুল ইসলাম।
রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থগিত ছিলো তথ্যকে ‘ভুল’ অবহিত করে এমন তথ্য দেওয়ার দায়ে রেল নিয়ন্ত্রক জহিরুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করেন রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক।
শুক্রবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গণমাধ্যমে এতথ্য জানান রেল মন্ত্রণালয়ের তথ্য কর্মকর্তা মো. শরিফুল আলম।
(দ্য রিপোর্ট/আরএইচ/নূরু/এইচএসএম/ডিসেম্বর ১৫, ২০১৩)