‘আলোচনায় নয়, সমাধান হবে অন্য পথে’
আওয়ামী লীগ-বিএনপির অনড় অবস্থানের কারণে আলোচনার মাধ্যমে নয়, চলমান রাজনৈতিক সঙ্কটের সমাধান হবে অন্য কোনো পথে। এমন বক্তব্যই বেরিয়ে এসেছে রাজনীতি বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদদের মন্তব্যে।
রাজনীতি বিশ্লেষক ড. মিজানুর রহমান শেলী দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সঙ্কট নিরসনে সরকার যদি বড় ধরনের ছাড় দেয়, তাহলে এখনো সমঝোতা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে সংবিধানের মধ্যে থেকেই নির্বাচন আরো ১০ দিন পর অথবা ২৪ জানুয়ারির মধ্যে যে কোনো দিন হতে পারে। তবে দুই দলের অবস্থান দেখে ছাড় দেবে বলে মনে হয় না। তাই সমাধান হবে অন্য কোনো পথে।’
দুই দলের মধ্যে বিরাট মতপার্থক্য রয়েছে উল্লেখ করে ড. মিজানুর রহমান শেলী বলেন, ‘আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে বদ্ধপরিকর। সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী এটাই হতে হবে। অন্যদিকে বিরোধী দল কোনোক্রমেই দলীয় সরকার বা আওয়ামী লীগের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। ইতোমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। এ অবস্থায় সমঝোতা কঠিন হয়ে পড়ছে।’
শেলী বলেন, ‘তারানকোর মধ্যস্থতায় দুই দলের মধ্যে আলোচনা শুরু হলেও ভেতরের কথাবার্তা নিয়ে দুই দলের কেউ কিছু বলছেন না। এর থেকে যদি কোনো ব্যর্থতার সংবাদ আসে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। আর সাফল্য যদি আসে, তা হবে খুবই চমৎকার এবং চমকপদ বিষয়।’
ড. শেলী আরও বলেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যদি সমঝোতা হয়, তাহলে বিরোধী দলকে এখন কিভাবে এ নিবার্চনে নিয়ে আসবে। তিনি বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন- ক্রমেই বিএনপির এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এ সময়সীমার মধ্যে সরকারি দল একটি বড় ধরনের ছাড় দিলে নির্বাচনী তফসিল বাতিল করে নতুন তফসিল ঘোষণা করতে পারে। তাতে ১০-১২ দিন পিছিয়ে নির্বাচন ১৬ কী ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত যেতে পারে। তবে নির্বাচন কমিশন এটা করবে কিনা, সেটাও দেখতে হবে। আবার এ স্বল্প সময়ের মধ্যে বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনাও যাবে না। তার মানে সমাধান-সমঝোতা কোনোটাই হচ্ছে না। সংলাপ কতদিন চলবে তাও জানি না।
সমঝোতা হলে কী ধরনের ফলাফল আসতে পারে- এমন প্রশ্নের উত্তরে শেলী বলেন, নির্বাচনের আশায় সংলাপে সমঝোতার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সমঝোতা না হলে দেশে অন্য কোনো পথে কেউ ক্ষমতায় আসবে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
সঙ্কট উত্তরণের সমাধান সম্পর্কে শেলী বলেন, ‘যাদের হাতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা তারা যদি বড় ধরনের ছাড় না দেয়, সমাধান হয়ত অন্য কোনো পথে আসবে ।’
‘অন্যপথ’ সম্পর্কে তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, যা আমরা জানি না। আলোচনা মাধ্যমে নয়, সমাধান হবে অন্য কোনো পথে। ঘটনাপ্রবাহ অন্যদিকে চলে যেতে পারে। এরপর যদি একটা সমাধান আসেও সেটা বিলম্বিত হতে পারে।
চলমান সঙ্কট নিয়ে ড. মিজানুর রহমানের ধারণা যে একেবারেই অমূলক নয়, তা দুই দলের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য, সংলাপ-সংলাপ খেলা, সংঘাতময় পরিবেশ সৃষ্টির ফলে অনেকটাই প্রকাশ পাচ্ছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে শনিবার ধানমন্ডিতে শেখ হাসিনার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোর পর আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বলেছেন, নির্বাচনে এগিয়ে গেলেও বিএনপির সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাব।
হানিফ বলেন, দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশ নেওয়ার সুযোগ শেষ হওয়ার পর জাতিসংঘ মহাসচিবের দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর উদ্যোগে আলোচনায় বসেন দুই প্রধান দলের নেতারা। ওই আলোচনার বিষয়ে হানিফ বলেন, ‘চলমান সংলাপ অব্যাহত থাকবে।’
এদিকে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে শনিবার সন্ধ্যায় সংলাপ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘নির্বাচন নাটক বন্ধ করার জন্যই বিএনপি সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে।’
শনিবার বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আমরা কিছু পয়েন্ট দিয়েছি, বিএনপির পক্ষ থেকেও কিছু পয়েন্ট এসেছে। এ সব পয়েন্ট নিয়ে দুই দলের নেত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী কৌশল ঠিক করা হবে।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা আমাদের সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব আওয়ামী লীগের কাছে দিয়েছি এবং আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আমরা নীতিনির্ধারণী ফোরামে এ সব নিয়ে আলোচনা করব। তারাও তাদের নীতিনির্ধারণী ফোরামে আমাদের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করবেন।’
জাতিসংঘের রাজনীতি বিষয়ক সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতারা দুটি বৈঠক করেন। গত ৯ এবং ১০ ডিসেম্বর এ বৈঠক দুটি হয়। কিন্তু ওই দুই বৈঠকে কোনো সমঝোতায় পৌঁছতে পারেননি নেতারা।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামছুজ্জামান দুদু দ্য রিপোর্টকে বলেন, সরকারকে বুঝানোর চেষ্টা করছি সংবিধান সংশোধন করার পর থেকে, কিন্তু সরকার বুঝার চেষ্টা করছে না। এটা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও আলোচনা হচ্ছে। এখনো সুযোগটা আছে।
এদিকে সংলাপের ব্যাপারে সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না ১৮ দলীয় জোটের শরিকরাও।
লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান দ্য রিপোর্টকে বলেন, এ ধরনের নাটক দেখানো সংলাপে গিয়ে লাভ হবে না। নির্দলীয় সরকার নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে কেবল সংলাপে যাওয়া উচিত। তাছাড়া সরকার যদি সংলাপের ব্যাপারে আন্তরিক হতো তাহলে পাখির মতো গুলি করে মানুষ মারত না। নির্বাচনের মানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যাওয়া নয়। অন্যদিক সংলাপের নামে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। যা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্যই করা হচ্ছে। বিরোধী দল মনে করছে, সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের সম্ভাবনা খুবই কম। রাজনৈতিক সমস্যা রাজপথেই সমাধান করতে হবে। তাই সংলাপের চেয়ে এখন আন্দোলনকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি।
(দ্য রিপোর্ট/এমএইচ/শাহ/এইচএসএম/ডিসেম্বর ১৭, ২০১৩)