একটি লালনিশান মুছে দেয় কৃষকের স্বপ্ন
বিলাস দাস, পটুয়াখালী : আমন মৌসুমেও হাসি ফোটেনি চরাঞ্চলের কৃষকের মুখে। একটি লালনিশান কেড়ে নেয় তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নকে।
এমনই দৃশ্য দেখা গেছে জেলার বেশ কয়েকটি উপজেলার চরগুলোতে। আমনের মৌসুম এলেই উপজেলার চরগুলোতে সোনালি ধানের বুক চিরে জেগে ওঠে প্রভাবশালীদের দেওয়া লালনিশান। স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা বা প্রভাবশালীদের পোষ্য লাঠিয়াল বাহিনীর দৃষ্টি এড়িয়ে পাকা ধান গোলায় তুলতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে জেলার অন্তত তিন ডজন চরের হাজারো কৃষকের সংশয় দেখা দিয়েছে।
প্রকৃতির ঋতু বদলে এ চরাঞ্চলে প্রতিবছরই আসে আমন মৌসুম। এ আশায় কৃষকরাও অধিক আনন্দে আমনের চাষ করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কিন্তু ফলাফল সেই শূন্যের কোটায়। যে সরকারই আসুক না কেন প্রভাবশালীদের কাছ থেকে কৃষকের ধান রেহাই দিতে ব্যর্থ হয়। আর অদৃশ্য কারণে স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকা সর্বদাই থাকে রহস্যময়। কোন বছরই কৃষকের ক্ষেতে ফলানো আমন তার গোলায় নিতে পারছে না। আর এর নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় চেয়ারম্যান, মেম্বার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা।
ইতোমধ্যে বাউফল উপজেলার মমিনপুর, চরতাবলীগ, মঠবাড়িয়ার চর, চরহেদায়েত, চরঈশান ও বাসুদেবপাশাসহ একাধিক চরে প্রভাবশালীরা লালনিশান পুঁতে দিয়েছে।
ওই চরের ফিরোজ, আনছার আকন, মস্তফা আকন, নূর মোহাম্মদ আকন, মোসলেম সিকদার, লালু সাজ্জাল, হেলাল উদ্দিন হাওলাদার, এসহাক মৃধা, রব মোল্লা, হিরণ মৃধাসহ একাধিক কৃষক অভিযোগ করে বলেন, বেশ কয়েক বছর তারা সরকারি খাস জমি লিজ (ডিসিয়ার কেটে) নিয়ে ধান চাষ করে আসছেন। কিন্তু কোন বছরই তাদের ফলানো ধান তাদের গোলায় নিতে পারছেন না। ভূমি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহযোগিতায় ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। এরপর আমন মৌসুম এলে কৃষকের ফলানো ধানক্ষেতে নিশান পুঁতে দেয় তারা। লালনিশান সম্পর্কে তিনি বলেন, এটা মানে হলো তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। এখানে সাধারণ মানুষ অথবা কৃষক নামলে তাদের বিপদ নিশ্চিত। শুধু নিশান নয়, তাদের লাঠিয়াল বাহিনী দ্বারা কৃষকের ফলানো ধান কেটে নিয়ে যায়। এ নিয়ে স্থানীয় আইনি সহযোগিতা নিয়েও কোন লাভ হয় না তাদের। মামলা করলে উল্টো হামলার শিকার হতে হয় প্রভাবশালী মহল দ্বারা।
একইভাবে রাঙাবালীর উপজেলার চর হেয়ার, চরযমুনা, চরগঙ্গা, চরকানকুনিসহ একাধিক চরে চলছে প্রভাবশালীদের তৎপরতা। আমন মৌসুম এলে এরা যেন বেপরোয়া হয়ে ওঠে। আন্ডারচরের কৃষক হেলাল আকন বলেন, চরাঞ্চলে একাধিক ভূমিহীনরা প্রতিবছর সরকারি খাস জসি লিজ নিয়ে ধানসহ নানা ফসল ফলায়। কিন্তু প্রভাবশালীরা ফসল তোলার ৩-৪ দিন আগে কৃষকের ক্ষেতে লালনিশান উড়িয়ে দেয়। এরপর কোন দিন তাদের পোষ্য প্রতিনিধি নিয়ে জোরপূর্বক কৃষকের ফলানো ধান কেটে নিয়ে যায়। এ নিয়ে কোন ওজরআপত্তি চলে না। হেলাল আরো বলেন, স্থানীয় রাজনীতিক ও সরকারি মহলটির সঙ্গে লাঠিয়াল বাহিনীর আঁতাত থাকায় কৃষকের হয়ে কেউ কথা বলে না। থানা গিয়ে অভিযোগ দিতে আর ঘটনাস্থলে পুলিশ আসতে আসতে তারা ধান কেটে নিয়ে গা ঢাকা দেয়। আবার মামলা হলেও কোন ফল হয় না বলে কৃষকরা মামলাও করে না। তিনি আরো বলেন, শুধু ধান কাটা নয়, এ নিয়ে হতাহতের ঘটনাও ঘটে প্রতিবছর।
রাঙাবালীর চর যমুনা সেকান্দার আলী বলেন, ‘গতবারও ক্ষেতের ধান পাই নাই। বাহিনীর লোক রাতে আমারে ডাইক্কা লইয়া কাগুজে টিপসই নেয়। এর পরদিন শনিবার তার লোকজন জমিনের ধান কাইটট্যা নিছে। অনেক মানুষ চাইয়া চাইয়া দেখছে। থানায় গেছিলাম! কিন্তু স্যার বলছে, তুমি যাও আমি লোক পাঠাচ্ছি। সন্ধ্যার পরে তারা (পুলিশ) আসে। কিন্তু ধান আর লাঠিয়াল কিছুই তারা পায় নাই। এরপর তারা যাওয়ার সময় বলে, আবার এলে আমাদের খবর দিও।
এ বিষয়ে পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার রফিকুল হাসান গনি বলেন, যারা প্রকৃত কৃষক এবং যারা ক্ষেতে ধান ফলিয়েছে তারা মুলত ধান গোলায় নিতে পারবে। আর এ জন্য পুলিশ তাদের সহযোগিতায় থাকবে। তিনি আরো বলেন, যে সকল জমি নিয়ে সমস্যা হয় তাদেরকে (কৃষককে) আবেদন করতে বলেছিলাম, ক্ষেতে ফষল ফলানো পূর্বেই যেন সমস্যা নিরসন হয়।
(দ্য রিপোর্ট/বিডি/শাহ/জেএম/ডিসেম্বর ১৮, ২০১৩)