অবরোধে জ্বালানি সরবরাহ ব্যাহত, হুমকিতে বোরো চাষ
হরতাল-অবরোধের কারণে রেল ও সড়কপথে চট্টগ্রাম থেকে সারাদেশের বিভিন্ন ডিপোয় জ্বালানি তেল সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। যেসব অঞ্চলে রেল ও সড়কপথে তেল পাঠানো হয় সেখানে এরই মধ্যে সরবরাহ সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এদিকে ডিসেম্বরে দেশে বোরো মৌসুম শুরু হয়েছে। মৌসুমের শুরুতে সেচ কাজের জন্য কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী ডিজেল সরবরাহ করতে না পারায় হুমকির মুখে পড়েছে বোরো আবাদ।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) একটি সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আসা জ্বালানি তেল নৌ ও রেলপথে সারাদেশের বিভিন্ন ডিপোয় পাঠানো হয়। সেখান থেকে ডিলার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এ তেল সংগ্রহ করে। চাষাবাদের চাপ থাকায় বিপিসি বোরো মৌসুমে দৈনিক ৩০ হাজার টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করে। জ্বালানি তেল সরবরাহকারী তিনটি প্রতিষ্ঠান যমুনা, পদ্মা, মেঘনার মাধ্যমে এ তেল সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে যমুনা ১১ হাজার, মেঘনা ১০ হাজার ও পদ্মা ৯ হাজার টন জ্বালানি পায়। কিন্তু অবরোধের কারণে সড়ক ও রেলপথ বন্ধ থাকায় এখন দৈনিক গড়ে ১৫ হাজার টন জ্বালানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সাধারণত ডিসেম্বর-জানুয়ারি সময়ে দেশে বোরো আবাদ শুরু হয়। কৃষক সেচকাজের ৮০ শতাংশ সম্পন্ন করে ডিজেল দিয়ে। বাকিটা বিদ্যুতের মাধ্যমে করে। এ বছর বোরো মৌসুমে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি সরবরাহ করা যাচ্ছে না। শুরুতে সেচকাজের জন্য প্রয়োজনীয় ডিজেল না পেয়ে আবাদ শুরু করতে পারছেন না কৃষক।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ফেলো (বিআইডিএস) কাজী শাহবুদ্দিন এ বিষয়ে দ্য রিপোর্টকে বলেন, প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষক ডিজেলের ওপর নির্ভরশীল। বোরো মৌসুম শুরু হলেও কৃষক পর্যায়ে ডিজেল সরবরাহ করা যাচ্ছে না, যা দেশের খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাকে ব্যাহত করবে।
কাজী শাহবুদ্দিন বলেন, বোরো আবাদ পুরোপুরি সময়ের ওপর নির্ভরশীল। সঠিক সময়ে বীজ বপনের পাশাপাশি সেচও দিতে হয়। সময়মতো সেচ না পেলে ফসল নষ্ট হয়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক ওয়ারেস কবির বলেন, কৃষকদের সময়মতো ডিজেল সরবরাহ করতে না পারলে বোরো আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বোরো মৌসুম সামনে রেখে কৃষকপর্যায়ে ডিজেল সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।
বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, খুলনার দৌলতপুর ডিপোয় চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জাহাজ থেকে সরাসরি নৌপথে তেল সরবরাহ করা হয়। সেখান থেকে রেলপথে পাঠানো হয় রাজশাহী ও নাটোরে। অন্যদিকে ঢাকা, সিলেট, পার্বতীপুর, শ্রীমঙ্গল ও চাঁদপুরের ডিপোগুলো রেলপথনির্ভর। অবরোধের মধ্যে নৌপথের ডিপোগুলোয় তেল সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও দেশের অধিকাংশ ডিপোয় তেল পরিবহনে সমস্যায় পড়ছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো।
যমুনা তেল কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, অবরোধের কারণে গত দুই সপ্তাহে শুধু সাপ্তাহিক ছুটির দিনে রেলপথে তেল সরবরাহ সম্ভব হয়েছে। যমুনা অয়েল স্বাভাবিক সময়ে দৈনিক ৯ হাজার টন তেল বিক্রি করে। তবে বোরো মৌসুমে কৃষক পর্যায়ে চাহিদা বৃদ্ধিতে দৈনিক তেল বিক্রির পরিমাণ ১১-১২ হাজার টনে পৌঁছে যায়। কিন্তু ৫ থেকে ৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি সর্বমোট ১৮ হাজার ৬৭০ টন তেল সরবরাহ করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির জ্বালানি তেল বিক্রির গড় ৬ হাজার ৬২৩ টন, যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ২ হাজার ৫০০ টন কম।
যমুনা অয়েল কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলীম উদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে দ্য রিপোর্টকে বলেন, হরতাল-অবরোধে রেল ও সড়কপথে জ্বালানি তেল পরিবহনে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ জন্য সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোয় ডিপো থেকে ডিলারদের তেল সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে। অবরোধ অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে সারাদেশে জ্বালানি তেল সরবরাহে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি হবে।
রেলওয়ে পরিবহন শাখা সূত্রে জানা গেছে, হরতাল-অবরোধে অকটেন, পেট্রল, ডিজেল, ফার্নেস অয়েল ও কেরোসিনবাহী ওয়াগনগুলো চালানো হচ্ছে না। বড় ধরনের দুর্ঘটনা ও রেলের ক্ষতি এড়াতে শুধু হরতাল ও অবরোধহীন দিনগুলোয় অতিরিক্ত পুলিশ প্রহরায় পাঠানো হচ্ছে তেলভর্তি ওয়াগন।
চট্টগ্রাম থেকে দেশের ছয়টি গন্তব্যে মাসে ৯৫ থেকে ১০০টি তেলবাহী ওয়াগন পরিবহন করা হয়। এর মধ্যে শ্রীমঙ্গল, সিলেট ও ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ওয়াগন যায়। স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে ৩২টি, ঢাকায় ১৬টি, পার্বতীপুর, রংপুর ও চাঁদপুরে ২০টি করে তেলবাহী ওয়াগন পরিবহন করা হয়। এর আগে হরতালে স্বল্প পরিসরে তেলবাহী ওয়াগন পরিসেবা চালু রেখেছিল রেলওয়ে। কিন্তু গত দুই সপ্তাহের সহিংস অবরোধের কারণে ঝুঁকি এড়াতে কনটেইনার ওয়াগন চালানো হলেও তেলবাহী ওয়াগন চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
এ বিষয়ে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চিফ কন্ট্রোলার (স্টক) মোশারফ হোসেন চৌধুরী দ্য রিপোর্টকে বলেন, দাহ্য পদার্থ হওয়ায় জ্বালানি তেল পরিবহনে ঝুঁকি বেশি। এই সতর্কতা অবলম্বনের অংশ হিসেবে তেলবাহী ট্যাংকার ওয়াগন পরিবহন বন্ধ রয়েছে। তবে ছুটির দিনগুলোতে আমরা তেল সরবরাহ করে যাচ্ছি।
এ বিষয়ে ফেনীর দাগনভূঁইয়ার কৃষক গিয়াস উদ্দিন বলেন, এ বছর আমনের ফসল ভালো হলেও ভালো দাম পায়নি। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বোরো মৌসুম নিয়ে আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু সময়মতো ডিজেল না পেয়ে আবাদ শুরু করতে পারিনি।
রাজশাহীর ধামইরহাটের কৃষক নারায়ণ ঘোষ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা তো রাজনীতি করিও না, বুঝিও না। তারপরও রাজনীতির স্বীকার আমরা। গেল মৌসুমে ধানের নায্যমূল্য পাই নাই। এবার ভাবছিলাম সেই ক্ষতি কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু সময়মতো ডিজেল না পেয়ে এখনও আবাদই শুরু করতে পারলাম না।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) নিয়মিত বৈঠকেও তেল সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কোম্পানিগুলোকে সচেষ্ট থাকতে বলা হয়।
(দ্য রিপোর্ট/এএইচ/শাহ/এইচএসএম/নূরু/ডিসেম্বর ১৮, ২০১৩)