পুলিশি হামলায় ইমরানসহ আহত ২০
শুক্রবার গণজাগরণ মঞ্চের বিক্ষোভ
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার বিকেল ৩টায় রাজধানীর শাহবাগসহ সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিল কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চ।
পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাও কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন গুলশান-২ গোল চত্বর এলাকায় গণজাগরণ মঞ্চের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হামলা চালায় পুলিশ। পুলিশের লাঠিচার্জে মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ (বীর বিক্রম) ও গণজাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক ইমরান এইচ সরকারসহ ২০ জনের অধিক আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে নয়জনকে আটক করা হয়।
বৃহস্পতিবার পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গুলশান-২ গোল চত্বরে জড়ো হতে থাকেন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা। এসময় তারা পাকিস্তান, যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াতের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন। সমাবেশের শুরুতে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের উপর চড়াও না হলেও সমাবেশস্থলে অংশগ্রহণে বাধা দিতে থাকে পুলিশ। এসময় সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আক্কু চৌধুরী, সমাজকর্মী খুশি কবির, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তারানা হালিমসহ গণজাগরণ মঞ্চের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
সমাবেশ চলা অবস্থায় গুলশান-২ এলাকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান নেয়। এসময় একাধিক প্রিজন ভ্যান, জল কামান, পুলিশে ব্যবহৃত এপিসিও প্রস্তুত রাখা হয়।
সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গণজাগরণ মঞ্চে জনসমাগম বাড়তে থাকে। এসময় গণজাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে মঞ্চের কর্মী ও দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উস্কানি না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী পাকিস্তান হাইকমিশন ঘেরাও করার কথা থাকলেও বৃহস্পতিবার গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা সেদিকে যাওয়ার কোনো চেষ্টা করেননি। শান্তিপূর্ণভাবে অবস্থান করলেও বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে হঠাৎ করে তাদের উপর চড়াও হয় পুলিশ। প্রথমে তারা মঞ্চের কর্মীদের সমাবেশ স্থল থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এসময় মঞ্চের কর্মীরা পুলিশের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিছু সময় তাদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি চলে। এক পর্যায়ে পুলিশ তাদের উপর বেধড়ক লাঠি পেটা শুরু করে। একই সঙ্গে সমাবেশস্থল থেকে মুক্তিযোদ্ধা আক্কু চৌধুরী, সমাজকর্মী খুশি কবির ও সংসদ সদস্য তারানা হালিমকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া হয়।
পুলিশ এসময় প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ূন আজাদের ছেলে অনন্য আজাদ, গণজাগরণকর্মী রওশান আরা নিপা, জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসানসহ চারজনকে আটক করে প্রিজন ভ্যানে তোলে।
আটক কর্মীদের ছাড়িয়ে নিতে এবং পুনরায় একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ আবারও গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের উপর চড়াও হয়। এবার গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ পথচারীদেরও বেধড়ক লাঠিপেটা করে পুলিশ। এসময় গুলশান-২ এলাকায় সকল প্রকার যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় আশপাশের সকল মার্কেট ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান।
পুলিশি অ্যাকশন চলা অবস্থায় গণজাগরণ মঞ্চের সমন্বয়ক ইমরান এইচ সরকার ও খুশি কবিরসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ পুনরায় জমায়েত হওয়ার চেষ্টা করেন। এসময় সেখানে অবস্থান নেওয়া পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের ঘিরে ফেলেন এবং ওই এলাকা থেকে চলে যেতে বলেন। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চের নেতৃবৃন্দ সমাবেশ করতে চাইলে তাদের উপর আবারও চড়াও হয় পুলিশ। গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা এসময় পুলিশকে উদ্দেশ্য করে গালিগালজ করতে থাকেন। তাদের কটুক্তির একপর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ বীর বিক্রমসহ অন্যদের উপর লাঠিচার্জ শুরু করেন। পুলিশের লাঠিচার্জে ইমরান এইচ সরকারসহ বেশ কয়েকজন আহত হন।
আহত ইমরান এইচ সরকারকে প্রথমে গুলশান-২ এর ল্যাব এইড হাসপাতালে নেওয়া হয়। এসময় রাস্তায় পড়ে থাকেন মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ। ল্যাব এইড হাসপাতাল থেকে ইমরান এইচ সরকারকে পরে ইউনাইটেড হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
পুলিশ গণজাগরণ মঞ্চের স্লোগান কন্যা শাম্মী আক্তারসহ আরও তিনজনকে আটক করে। আটকাবস্থায় ব্রিটিশ-আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাহাঙ্গীর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি গণজাগরণ মঞ্চের কেউ না। এখানে ঘুরতে এসেছিলাম। গণ্ডগোল দেখে বাড়ি ফেরার সময় পুলিশ আমাকে আটক করে। পরিচয়পত্র দেখানোর পরও পুলিশ আমাকে ধরেছে।’
পুলিশকর্তৃক বিশিষ্টজনেরা লাঞ্ছিত :
গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীদের উপর পুলিশি অ্যাকশনে মুক্তিযোদ্ধা, সমাজকর্মী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের মতো বিশিষ্টজনেরা লাঞ্ছিত হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আক্কু চৌধুরী ও সমাজকর্মী খুশি কবিরকে ধাক্কা দিয়ে সমাবেশস্থল থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এসময় তাদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা হয়। পুলিশ সদস্যরা তাদের সঙ্গে ‘তুই-তুকারি’ ও অসদাচরণ করেন। পরে পুলিশে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে পুলিশ সদস্যদের সরিয়ে দেন এবং আক্কু চৌধুরী ও খুশি কবিরকে সমাবেশ স্থল থেকে সরে যেতে অনুরোধ করেন।
পুলিশের এডিসি আয়েশা সিদ্দিকী এসময় আক্কু চৌধুরীর উদ্দেশে বলেন, ‘স্যার আমরা কী আপনাদের সন্তান না। আমাদের কথা কী আপনারা রাখবেন না। প্লিজ স্যার এটা ডিপ্লোমেটিক জোন, সবাইকে নিয়ে আপনারা চলে যান।’
আয়েশা সিদ্দিকীর কথার পরিপ্রেক্ষিতে আক্কু চৌধুরী বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি, তোমাদের মতো সন্তানের পিতা হওয়ার জন্য নয়। তোমরা যেভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের পেটাচ্ছো তাতে ভাবতে লজ্জা হয় তোমরা আমাদের সন্তান।’
অন্যদিকে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গুলশান-২ এর বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয়। নাট্যব্যক্তিত্ব ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য তারানা হালিম গণজাগরণ মঞ্চের কয়েকজন কর্মীকে নিয়ে কাকলী-গুলশান-২ নম্বর রোডে অবস্থান নেন। পুলিশ সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। এসময় একাধিক পুলিশ কনস্টেবল তারানা হালিমের সঙ্গে অসদাচরণ করেন। পুলিশ সদস্যরা তারানা হালিমের উদ্দেশে বলতে থাকে, ‘এখানে কী তোদের, এখান থেকে যেতে বললাম না। বলছি না এটা ডিপ্লোমেটিক জোন। না গেলে কিন্তু মার খাবি।’
পুলিশের এক সদস্য মহিলা পুলিশ সদস্যদের ডাকতে থাকেন। তারানা হালিম এসময় মুঠোফোনে সরকারের একাধিক উচ্চপর্যায়ের কর্তাব্যক্তিদের সার্বিক বিষয়ে অভিযোগ করতে থাকেন।
পরে তিনি উপস্থিত গণমাধ্যম কর্মীদের জানান, পাকিস্তান হাইকমিশন সরকারকে ফোন করে বলেছে তারা নাকি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তাই তারা সরকারের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছেন। কিন্তু পুলিশ আমাদের সঙ্গে কেন এমন আচরণ করছে তা জানি না। বিষয়টি তদন্ত হওয়া উচিৎ। তবে আমার জানা মতে সরকারের নির্দেশে পুলিশ এমনটি করছে না।
পুলিশের আচরণে হতভম্ব সবাই :
গণজাগরণ মঞ্চের সমাবেশে শুরু থেকেই বাধা দিতে থাকে পুলিশ। এসময় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আক্কু চৌধুরী দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমরা মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমাদের রক্তেই পুলিশ আজ স্বাধীনতা পেয়েছে। আর সেই পুলিশ আমাদের উপর হামলা করছে, আমাদের বাধা দিচ্ছে। পুলিশের এমন আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তারা পাকিস্তানের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে।’
আক্কু চৌধুরী আরো বলেন, ‘আজ পাকিস্তান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে যেভাবে অবস্থান নিয়েছে তাতে তাদের বিচারের দাবিরও সময় এসেছে। যারা আমাদের মানুষকে হত্যা করেছে, আমাদের মা-বোনের ইজ্জত লুটেছে তাদেরও বিচার এখন করতে হবে। তাদের দোসর রাজাকারদের তো বিচার হবেই, একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যায় জড়িত পাকিস্তানিদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
গণজাগরণ মঞ্চের উপর পুলিশের হামলার ঘটনায় সমাজকর্মী খুশি কবির দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘শান্তিপূর্ণ একটি সমাবেশের উপর পুলিশের এমন হামলায় আমরা হতবাক হয়েছি। ভাবতে কষ্ট হয়, এরা বাংলাদেশের পুলিশ। তাদের আচরণে মনে হয়েছে, তারা পাকিস্তানের নির্দেশে আমাদের উপর হামলা করেছে। ওরা পাকিস্তানি পুলিশ।’
আহত মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘যারা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করতে জানে না, তারা স্বাধীনতার পক্ষের- এটা কিভাবে বলি। আজ আমরা এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তিরা সমাবেশ করতে চেয়েছি। কিন্তু পুলিশ কার নির্দেশে এভাবে আমাদের উপর হামলা চালালো। এর জবাব প্রশাসন ও পুলিশকেই দিতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘পুলিশের উপর যখন জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা হামলা করে, তখন আমরাই তো পুলিশের প্রতি সহমর্মিতা জানায়। আজ সেই পুলিশই আমাদের উপর হামলা করেছে। ওরা জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে পারে না। আমাদের মতো শান্তিপ্রিয় নিরস্ত্র মানুষের উপর হামলা করতে পারে।’
পুলিশের বক্তব্য :
বিনা উস্কানিতে গণজাগরণ মঞ্চের শান্তিপূর্ণ সমাবেশের উপর পুলিশের হামলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশের যুগ্ম কমিশনার শাহবুদ্দিন খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমরা তাদের উপর হামলা করিনি। ডিপ্লোমেটিক জোন হওয়ায় তাদের সরে যেতে বলেছি। কিন্তু তারা সরে না যাওয়ায় পুলিশ তাদের সরাতে চেষ্টা করে, তখন তাদের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয়। তাদের ছত্রভঙ্গ করতে মৃদু লাঠিচার্জ করা হয়েছে সত্য, কিন্তু কেউ তেমন আহত হননি।’
সংসদ সদস্যসহ বিশিষ্টজনদের লাঞ্ছিত করা প্রসঙ্গে শাহবুদ্দিন বলেন, ‘পুলিশের কোনো সদস্য কারো সঙ্গে অসদাচরণ করেনি। তারপরও যদি কেউ এ ধরনের কাজ করেন তা হলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ঘটনাস্থল থেকে কয়েকজনকে আটকের কথা স্বীকার করে তিনি আরো বলেন, ‘অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয় তাই কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।
গণজাগরণ মঞ্চের নতুন কর্মসূচি :
শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশি হামলার প্রতিবাদে শুক্রবার বিকেল ৩টায় শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চসহ সারাদেশে বিক্ষোভ সমাবেশ ও প্রতিবাদ মিছিল কর্মসূচির ঘোষণা করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন মঞ্চের অন্যতম উদ্যোক্তা মারুফ রসুল।
(দ্য রিপোর্ট/এইচআর/এসআর/এমএআর/ডিসেম্বর ১৯ ২০১৩)