চট্টগ্রাম সংবাদদাতা : ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে গার্মেন্টস পণ্যবাহী কাভার্ডভ্যানের ভাড়া এক লাখ ৩০ হাজার থেকে ৩৫-৪০ হাজার টাকায় নেমে এলেও বাড়তি ভাড়া গুণতে হচ্ছে অন্যান্য রুটে পণ্য পরিবহনে। অবরোধ-হরতালসহ রাজনৈতিক অস্থিরতায় এখনও রাজশাহী-চট্টগ্রাম, বগুড়া-চট্টগ্রাম, মেহেরপুর-চট্টগ্রাম রুটে শীতকালীন সবজি এবং বেনাপোল-চট্টগ্রাম, হিলি-চট্টগ্রাম, সোনা মসজিদ-চট্টগ্রাম ও ভোমরা-চট্টগ্রাম রুটে ভারত থেকে আমদানি করা পেঁয়াজ ট্রাকে পরিবহন চলছে কয়েকগুণ অতিরিক্ত ভাড়ায়।

বেপারি ও আমদানিকারকরা বলছেন, অতিরিক্ত ভাড়ায় পণ্য পরিবহন করে কৃষক, বেপারি আর আমদানিকারকের কেউ লাভের মুখ দেখছেন না। পণ্যের লাভের অংশ চলে যাচ্ছে পরিবহন ভাড়ায়। তারা জানান, এসব গন্তব্য থেকে প্রতি কেজি পণ্য পরিবহনে ভাড়া যাচ্ছে ৮ থেকে ১০ টাকা করে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত নভেম্বরে টানা অবরোধ-হরতাল শুরুর আগেও ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পর্যন্ত প্রতিটি কাভার্ডভ্যানের ভাড়া ছিল সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু টানা অস্থিরতার সুযোগে বাড়তে থাকে ভাড়া। ভাড়া বৃদ্ধির এই ধারাবাহিকতায় এক লাফে ভাড়া উঠে যায় এক লাখ ৩০ হাজার টাকায়। বাড়তি ভাড়ায় পণ্য পরিবহনের এই ধারা একমাসেরও বেশি সময় চলার পর চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে ভাড়া ৩৫ থেকে ৪০ টাকায় নেমে আসে।

চট্টগ্রাম আন্তঃজেলা কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী দ্বীন মেহাম্মদ জানান, বিরোধী দলের অবরোধ-হরতালে যেভাবে গাড়ি জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর করা হয়েছে সে কারণেই সংকটের শুরু। সীতাকুণ্ডসহ কয়েকটি স্পটে গাড়ি জ্বালানোসহ চালক, হেলপার আহত, নিহত হওয়ায় তারা ভয়ে গাড়ি চালাতে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে দ্বিগুণ খরচে তাদের রাজি করা হয়। তার ওপর গত মাসের প্রথম দফায় অবরোধ-হরতালের শুরুতে গার্মেন্টসগুলোতে শিপমেন্টের তাড়া ছিল বেশি। সবমিলিয়ে কাভার্ডভ্যান ভাড়া ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠে যায়।

তিনি জানান, গত সপ্তাহ থেকে ভাড়া কমে এলেও লোডিং পণ্য পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ গার্মেন্টসগুলোর উৎপাদন কমে গেছে।

বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত প্রথম সহ-সভাপতি আবদুল ওয়াহাব জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের গার্মেন্টস শিল্পে ২৫ শতাংশ প্রোডাকশন লস হয়েছে। যখন শিপমেন্টের তাড়া ছিল তখন অতিরিক্ত ভাড়ায় পণ্য পরিবহন করতে হয়েছে। এখনও যে ভাড়া চলছে তাও স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।

অন্যদিকে রাজশাহী থেকে চট্টগ্রামের রেয়াজউদ্দিন বাজারে সবজিবাহী ১৫ টনের একটি বড় ট্রাকের ভাড়া ছিল ২৫ থেকে ২৮ হাজার টাকা। গত দুইমাস ধরে এর বিপরীতে প্রতি ট্রিপে গুণতে হচ্ছে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। মেহেরপুর থেকে রেয়াজউদ্দিন বাজারে প্রতি ট্রাকের ভাড়া ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা। স্বাভাবিক সময়ে এই ভাড়া ছিল ২৬ থেকে ২৮ হাজার টাকা। বগুড়া থেকে রেয়াজউদ্দিন বাজার পর্যন্ত প্রতি ট্রিপে ৩০ হাজার টাকার স্থলে এখন গুণতে হচ্ছে এক লাখ ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। এসব মোকাম থেকে ট্রাকে করে চট্টগ্রামে আসে টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, সীম, আলু, বেগুন ও মুলা।

রাজশাহীর বেপারি মনসুর রহমান জানান, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাজারে শাক-সবজির দাম বাড়লেও তার সুফল কেউ পায়নি। বাড়তি পরিবহন খরচে সব গেছে। বিক্রি করে কৃষক যেমন যথাযথ দাম পায়নি, তেমনি কম দামে কিনে লাভ করতে পারেনি বেপারিরাও। টানা অবরোধের কবলে পড়ে ট্রাক আটকে লাখ লাখ টাকার সবজি পচে গেছে। তার মতে, বর্তমানে দূরপাল্লা থেকে আসা প্রতি কেজি সবজি পরিবহনে ভাড়া চলে যাচ্ছে ৮-১০ টাকা।

এ রুটের ট্রাক চালক সোলায়মান জানান, হরতাল-অবরোধে সঠিক সময়ে গাড়ি পৌঁছার নিশ্চয়তা না থাকায় ভাড়া একটু বেশি। পথে পথে গাড়ি নিয়ে আটকে থাকতে হয় বলে স্টাফ খরচও বেড়ে গেছে। তাছাড়া প্রতি মুহূর্তে জীবন হাতে নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়।

একইভাবে বেনাপোল থেকে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ পর্যন্ত পেঁয়াজ ভর্তি ১৫ টনের ট্রাকের ভাড়া ঠেকেছে ৭০ হাজার টাকায়। স্বাভাবিক সময়ে এ রুটে ট্রাকের সর্বোচ্চ ভাড়া ২৮ হাজার টাকা। সোনা মসজিদ স্থল বন্দর থেকে খাতুনগঞ্জে ৩২ হাজার টাকার বিপরীতে এখন প্রতি ট্রাক পেঁয়াজ পরিবহনে গুণতে হচ্ছে এক লাখ টাকা। ভোমরা-চট্টগ্রামের ভাড়াও একই। হিলি থেকে খাতুনগঞ্জের ট্রাক ভাড়া ছিল ৩০ হাজার টাকা। এখন দিতে হচ্ছে ৮৫ থেকে ৯০ হাজার টাকা।

বেনাপোল-চট্টগ্রাম রুটের ট্রাক চালক আবদুর রহিম জানান, স্বাভাবিক সময়ে কম ভাড়ায় পণ্য নিয়ে এলেও ফিরতি পথে চট্টগ্রাম থেকে ভাড়া পাওয়া যেত। এখন হরতাল-অবরোধে ভাড়া পাওয়া যায় না। এ কারণে ভাড়ার সমন্বয় করতে সিঙ্গেল ট্রিপে বেশি ভাড়া নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক সৈয়দ ছগীর আহমদ জানান, পরিবহন ভাড়া নিয়ে যা চলছে তা তুঘলকি কারবার ছাড়া কিছুই নয়। এখন বাড়তি ভাড়ার যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন ভোক্তারা। যার মূল কারণ অস্থির রাজনীতি।

(দ্য রিপোর্ট/এমকে/এসকে/ডিসেম্বর ২০, ২০১৩)