কাওসার আজম, দ্য রিপোর্ট : মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শীর্ষ নেতাদের বিচার ও দণ্ডাদেশ নিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কূটনৈতিক মিশন অনেকটাই সফল হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের আগে ও পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তায়েফে এরদোগানের ফোন ও বিবৃতি এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার নাভি পিল্লাইয়ের চিঠি এ বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে দিয়েছে।

শীর্ষ নেতাদের বিচার ঠেকাতে ব্যর্থ হলেও বিচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলকে সন্দিহান করে তোলা এবং সরকারকে ইসলাম ও গণতন্ত্র বিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে জামায়াত অনেকটাই সফল বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।

গত ১২ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।

ফাঁসি কার্যকরের আগের দিন ১১ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না করতে টেলিফোন করেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি

একাধিকবার ফোন ও বিবৃতি দেন তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগান। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীকে তারা কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর না করার আহ্বান জানান।

এর আগের দিন ১০ ডিসেম্বর রাতে কাদের মোল্লার রায় কার্যকর না করতে আহবান জানান জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার নাভি পিল্লাই। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি এ সংক্রান্ত একটি চিঠি দিয়ে বলেন, কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ডের রায়ে আন্তর্জাতিক মান পূরণ হয়নি।

কিন্তু বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক এসব অনুরোধ বা আহ্বানে সাড়া দেননি। ১২ ডিসেম্বর কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়। পরের দিন ১৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিব বানকি মুন এ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। তুরস্কের এরদোগান সরকার এর প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানায়। কাদের মোল্লার রায়কে ভুল আখ্যা দিয়ে এরদোগান বলেন, এ জন্য ইতিহাস বাংলাদেশকে ক্ষমা করবে না।

কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের প্রতিক্রিয়ায় গত সোমবার পাকিস্তান সংসদে শোক ও নিন্দা প্রস্তাব পাশ করা হয়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়গুলো পুনরায় না এনে জামায়াত নেতাদের ওপর থেকে মামলা প্রত্যাহারেরও আহ্বান জানানো হয় সে দেশের সংসদ থেকে।

পাকিস্তান সরকারের এ প্রস্তাবকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ‍ওপর আঘাত বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। গত মঙ্গলবার পাকিস্তানী হাইকমিশনার আফরাসিয়াব মেহদী হাশমি কোরায়শিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ডেকে এনে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে নাক না গলাতে পাকিস্তান সরকারকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। হাইকমিশনারকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কড়া ভাষায় কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।

মানবতাবিরোধী অপরাধে শীর্ষ নেতাদের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই জামায়াতে ইসলামী রাজপথে আন্দোলন করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালায়। নেতাদের বিচার বন্ধে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত, ব্রিটিশ হাই কমিশনার, চীন, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দূতাবাসে নিয়মিতভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে দলটির নেতারা। একইসঙ্গে দেশের বাইরে দলীয় লবিস্ট দিয়ে বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, মন্ত্রী এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের দ্বারস্থ হয় জামায়াত।

জামায়াত সূত্র জানায়, শীর্ষ নেতাদের বিচার ঠেকাতে না পেরে তারা এ বিচারটিকে প্রশ্নবিদ্ধ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পাশাপাশি দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর সরকারের জুলুম-নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেন আন্তর্জাতিক মহল ও মিডিয়ায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জামায়াত বুঝাতে চেষ্টা করে রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যেই সরকার তাদের শীর্ষ নেতাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করছে এবং আন্দোলনরত নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম-নিযাতন চালাচ্ছে। একইসঙ্গে বর্তমান সরকারকে ইসলাম ও গণতন্ত্র বিরোধী বলেও প্রচারণা চালাচ্ছে দলটির নেতারা।

জামায়াত নেতাদের আন্তর্জাতিক লবিংয়ের কারণে তুরস্ক, মিশরসহ কয়েকটি মুসলিম দেশের প্রধানরা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। একইসঙ্গে জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ প্রভাবশালী কয়েকটি দেশ ও মানবাধিকার সংগঠনের পক্ষ থেকে বিচার আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে না বলে একাধিকবার মত প্রকাশ করে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে বিচার করার জন্য সরকারের প্রতি চাপ দেয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঢাকাস্থ মিশন প্রধান রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম হান্নাও বিভিন্ন সময় বলার চেষ্টা করেছেন ইইউ মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন করে না।

জামায়াতের এ মিশন অনেকটাই সফল বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ইতোমধ্যে এর প্রতিক্রিয়াও শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর পাকিস্তান, তুরস্ক, মিশর, মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি মুসলিম দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে।

গত ১৫ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, ‘বাংলাদেশ জাতিসংঘের একটি সদস্য রাষ্ট্র। দেশের সেনাবাহিনী ও ‍পুলিশ বাহিনী জাতিসংঘ মিশন ও বিভিন্ন দেশের শান্তি মিশনে গিয়ে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে। বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশের যে মর্যাদা তৈরি হয়েছিল এ সরকার তা ধ্বংস করে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করেছে।’

কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকে ফাঁসি স্থগিত রাখার আহ্বান জানানো হয়েছিল। কিন্তু সরকার তা শুধু অগ্রাহ্যই করেনি, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যও করেছে।’

আরেক বিবৃতিতে ২০ ডিসেম্বর শুক্রবার সন্ধ্যায় ডা. শফিকুর বলেন, ‘সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে দলীয় উচ্ছৃঙ্খল ক্যাডাররা রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকায় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে বিদেশি নাগরিক, কূটনীতিক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর হুমকি সৃষ্টি করছে। সরকারের বাড়াবাড়ির কারণে দেশ আন্তর্জাতিক মহলে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে।’ সরকারের বাড়াবাড়ির কারণে দেশ আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হবে বলেও আশঙ্কার কথা বলেন তিনি।

এ ব্যাপারে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘কাদের মোল্লার ফাঁসির পর পাকিস্তানের সংসদে নিন্দা প্রস্তাব ও শোক পাশ অত্যন্ত নিন্দনীয়। এতে প্রমাণ হয় অতীতের কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানীদের অনুশোচনা হয়নি।’

জামায়াতের কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে কাদের মোল্লার ফাঁসির আগে ও পরে জাতিসংঘ মহাসচিব, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোন ও বিবৃতি এবং পাকিস্তানের সংসদে নিন্দা প্রস্তাব পাশ হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হতে পারে। কারণ তারা তো তাদের নেতাদের বাঁচাতে চাইবেই। এছাড়া ওইসব দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই সেই বিবেচনায় বা নিজেদের স্বার্থে এসব করতে পারে। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুততার সঙ্গেই শেষ করা উচিত। যদি বিচার সুষ্ঠুভাবে হয়ে থাকে।’

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. পিয়াস করিম পাকিস্তানের সংসদে নিন্দা প্রস্তাব এবং জাতিসংঘ মহাসচিব ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোনকে এক দৃষ্টিতে দেখতে নারাজ। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘পাকিস্তান ১৯৭১ সালে গণহত্যা চালিয়েছে, তাদের সেনাবাহিনী ধর্ষণ ও লুটপাটের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। কাদের মোল্লার ফাঁসির পর পাকিস্তানের সংসদে নিন্দা প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য ও নিন্দনীয়। তবে কাদের মোল্লার ফাঁসির আগে ও পরে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের ফোন ও চিঠি ভিন্ন বিষয়। কারণ জাতিসংঘের অনেক দেশই মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। এমনকি আমেরিকার অধিকাংশ রাজ্যে মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। এই দৃষ্টিতে তারা কাদের মোল্লার ফাঁসির বিরোধিতা করতে পারে।’

জামায়াতের কূটনৈতিক তৎপরতায় এসব হয়েছে কিনা জানতে চাইলে পিয়াস করিম বলেন, ‘জামায়াতের তৎপরতায় এসব হয়েছে কিনা আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর অধিকার তাদের আছে। তবে শুধুমাত্র জামায়াতের তৎপরতায় জাতিসংঘ মহাসচিব ও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে ফোন দিয়েছেন এমন নয়। কারণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনও যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এ ব্যাপারে তারাও ভূমিকা রেখেছে বলে আমি মনে করি।’

ইইউ প্রতিনিধিদের বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে না যাওয়াকে জামায়াতের কূটনৈতিক তৎপরতার সঙ্গে এক করে দেখতে নারাজ এই সমাজ চিন্তক। তার মতে, দেশে যে একদলীয় নির্বাচন হচ্ছে এবং ১৫৪জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন এটির প্রতি অনাস্থা জানিয়েই বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যাননি।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে তাদের অনুসারীরা কূটনৈতিক তৎপরতাই শুধু নয়, বিপুল পরিমাণ পুঁজিও বিনিয়োগ করেছে। কাদের মোল্লার ফাঁসির পর পাকিস্তানের সংসদে নিন্দা প্রস্তাব পাশের কঠোর সমালোচনা ও নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, এতে প্রমাণ হয় জামায়াতের কূটনৈতিক তৎপরতা অনেকাংশেই সফল হয়েছে। আর পাকিস্তানের সংসদে নিন্দা প্রস্তাব পাশই প্রমাণ করে কাদের মোল্লা অপরাধী।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে একটি মহল সচেষ্ট রয়েছে। সরকারকে এ ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। চলমান সহিংসতা আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এইচএসএম/সাদি/ডিসেম্বর ২০, ২০১৩)