স্মৃতিতে একজন যুবরাজ
ইসহাক ফারুকী : খালেদ খান। মঞ্চ ও টিভির জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী। যুবরাজ বলেই যিনি পরিচিত ছিলেন সবার মাঝে। ২০ ডিসেম্বর শুক্রবার রাত ৮টা ১৮ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বাংলাদেশের প্রথম টেরিস্ট্রিয়াল টিভি চ্যানেল ‘একুশে টেলিভিশন’-এ ২০০০-২০০১ সালে সহকারী মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) পদে চাকুরি করেছিলেন খালেদ খান। সে সময়ের তার সহকর্মীরা স্মৃতির পাতা থেকে এক চিলতে কথা দ্য রিপোর্টের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিলেন।
‘এটিএন বাংলা’র অনুষ্ঠান উপদেষ্টা নওয়াজিশ আলী খান বললেন, আমি যুবরাজকে চিনি বিটিভি থেকে। ও (খালেদ খান) আর ওর স্ত্রীর (মিতা হক) সঙ্গে আমার পরিচয় বহুদিনের। যুবরাজ একজন সুঅভিনেতা। ও যখন ‘সকাল সন্ধ্যা’ বা ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকে অভিনয় করতে বিটিভিতে আসতো, তখন থেকেই আমার সঙ্গে সখ্যতা। এটা ভেবে খারাপ লাগছে, আমার প্রযোজিত নাটকে কখনও অভিনয় করার সুযোগ ঘটেনি যুবরাজের। তবে একটি বিষয় খুব মনে পড়ছে, ও খুব ভাল গান গাইতো। অবশ্য প্রফেশনালি কখনও গায়নি। তবে অত্যন্ত উচুমানের কণ্ঠশিল্পী ছিল।
ওর এই কণ্ঠের জাদু প্রকাশ পেয়েছে বিজ্ঞাপনচিত্র ও প্রামাণ্যচিত্রে ভয়েস দেওয়ার সময়। অনেক পরিস্কার ও সাবলীল কণ্ঠ ছিল। যেমন ধীরলয়ে উচ্চারণ করতে পারতো, তেমনি দ্রুতলয়েও। অনেকেকেই দেখি, দ্রুতলয়ে উচ্চারণ করতে গেলে জড়িয়ে যায়। কিন্তু খালেদ খান এদিক থেকে ব্যতিক্রম। দ্রুতলয়েও ওর উচ্চারণ ছিল পরিস্কার। এটা অসাধারণ। আর একুশে টেলিভিশনে যুবরাজ যখন আসে বেশিদিন অবশ্য চাকুরি করেনি। কিন্তু যতদিন করেছে দক্ষতার সঙ্গেই করেছে। ওর ম্যানেজ করার ক্ষমতাও ছিল প্রবল। আমি তখন অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান ছিলাম। তাই প্রয়োজনেই মানবসম্পদ ও প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হতো। তো, যখনি অনুষ্ঠানের খাতিরে যুবরাজের কাছে কিছু চাইতাম, তখনি সহযোগিতা পেতাম। টেলিভিশন মিডিয়ায় ওর মতো এতো দক্ষ প্রশাসক দেখিনি। ব্রডকাস্টিং মিডিয়ার ক্ষেত্রে যেটা প্রয়োজন, তা হল টেলিভিশন স্ক্রিনের স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখা। এই বিষয়টিকে ও খুব ভালভাবে গুরুত্ব দিয়েছিল। মোদ্দা কথা, ও একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। একজন যোগ্য লোক।
‘চ্যানেল টোয়েন্টি ফোর’-এর নির্বাহী পরিচালক হাসনাইন খুরশেদ বললেন, আমি তখন একুশে টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিনিধি। সারাদিন খবরের সন্ধানেই থাকতাম। খালেদ ভাই ছিলেন প্রশাসনের লোক। ওনার সঙ্গে খুব কমই দেখা হতো। যতটুকু সান্নিধ্য পেয়েছি, বুঝেছি যে, উনি খুব বন্ধবৎসল। আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে কাজ করতে বলতেন। আমরা যেন ভালভাবে কাজ করতে পারি, ভাল মানুষ হয়ে গড়ে উঠি, উন্নতির জন্য চেষ্টা করি সেজন্য বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন। গাইড করতেন। সেকথা কখনও ভুলতে পারব না।
গাজী টিভি’র অনুষ্ঠান প্রধান আমিনুল ইসলাম খোকন বললেন, যুবদা আমার শ্রদ্ধাভাজন বড়ভাই। তার সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ছিল। আমি তখন অনুষ্ঠান বিভাগের উর্ধ্বতন প্রযোজক ছিলাম। যদিও পদবী অনুযায়ী আমিও সহকারি মহাব্যবস্থাপক ছিলাম। আমার আর যুবদার মধ্যে পার্থক্য ছিল প্রশাসন ও অনুষ্ঠান বিভাগ। কিন্তু একজন বড়ভাই ও বন্ধু হিসেবে তাকে পেয়েছিলাম। একটা কথা খুব বেশি করেই মনে পড়ছে। আমি আর যুবদা একসঙ্গে ইটিভি’র সিঁড়িতে দাড়িয়ে ধুমপান করতাম। যদিও ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তবু এই কথাটি না বলে পারছি না। একুশে টিভিতে তার চাকুরির শেষ সময়ে অর্থাৎ ‘তারা টিভি’তে যুবদার যোগ দেওয়ার আগের কথা। তার শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। হৃদরোগ ধরা পড়ে। সেসময় একদিন আমি বললাম, ধুমপান করতে যাবেন নাকি? তিনি বললেন, নাহ! ডাক্তার নিষেধ করেছে। তারপর আবার বললেন, সিঁড়ি ঘরে যাচ্ছিস? চল। আমি বললাম, ডাক্তার না নিষেধ করেছে? তিনি বললেন, খাবো তোর সাথে। (দীর্ঘশ্বাস) ধুমপান করা ভাল না হলেও এটা নিয়ে আমরা কাজের ফাঁকে খানিকটা সময় কাটাতাম। অনেক খোঁচাখুচিও চলতো দুজনের মাঝে। এখন সেসব স্মৃতি।
অভিনেতা ও নির্দেশক ইউসুফ হাসান অর্ক বললেন, আমি আর তুহিন সেসময় একসঙ্গে একুশে টেলিভিশনের জন্য অনেক নাটক ও অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছি। আমাদের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘টাইমবেল’ থেকেই সব অনুষ্ঠান নির্মাণ করা হতো। সেসময় ইটিভিতে যুবদাকে পেয়েছি শুধু প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নয়। একজন বড় ভাই হিসেবে। ওনার মধ্যে কখনও বসিং টেন্ডেন্সি ছিল না। তার সহজাত প্রবৃত্তি দিয়েই তিনি আমাদের সঙ্গে মিশতেন। কাজগুলো যেন ভালভাবে হয়, সেজন্য পরামর্শ দিতেন। অফিসে বা বাইরের সবার সঙ্গেই তার যোগাযোগ অনেক ভাল ছিল। প্রাতিষ্ঠানিক, পারিবারিক ও থিয়েটার থেকেই তিনি এই শিক্ষা পেয়েছেন। আমরা যারা নব্বইয়ের নাট্যকর্মী, তাদের জন্য তিনি রোলমডেল, আইকন। তিনি আসলেই যুবরাজ।
(দ্য রিপোর্ট/আইএফ/জেএম/ডিসেম্বর ২১, ২০১৩)