প্রশাসনে বর্তমানে প্রায় ৮০০ বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) রয়েছেন। সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, পদের চেয়ে কর্মকর্তাদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সবাইকে পদায়ন করা যাচ্ছে না। এতে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা ওএসডি থাকছেন।

মূল বেতন ধরে এক হিসাবে দেখা গেছে, এ কর্মকর্তারা এক মাস ওএসডি থাকলে তাদের পেছনে এক কোটি ৮০ লাখ টাকার মতো ব্যয় হয়। এ পরিমাণ অর্থের পুরোটাকে অপচয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ওএসডি কর্মকর্তাদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ অধ্যয়নসহ নানা কারণে ওএসডি রয়েছেন। বাকি ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ কর্মকর্তা কোনো কারণ ছাড়াই গত প্রায় ৫ বছর ধরে ওএসডি রয়েছেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ওএসডি কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই মহাজোট সরকারের শুরু থেকে ওএসডি আছেন। মূলত রাজনৈতিক কারণে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করে রাখা হচ্ছে। কোনো কাজ না করা এসব কর্মকর্তাদের পেছনে প্রতিমাসে বেতন বাবদ বিপুল অঙ্কের সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শুক্রবারের তথ্য অনুযায়ী, প্রশাসনে ৭৯৬জন কর্মকর্তা ওএসডি রয়েছেন। সচিব ও সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন ৭১জন। এর মধ্যে ওএসডি চারজন। ২৩৯ অতিরিক্ত সচিবের মধ্যে ওএসডি ৩৯জন। ওএসডি কর্মকর্তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন যুগ্মসচিব। বর্তমানে ৩২৮জন যুগ্মসচিব ওএসডি রয়েছেন। প্রশাসনে যুগ্মসচিব রয়েছেন ১ হাজার ১৯জন। এছাড়া ১ হাজার ৩১৭জন উপসচিবের মধ্যে ১৬৪জন ওএসডি। ওএসডি সিনিয়র সহকারী সচিবের সংখ্যা ১৫৮জন। উপসচিব রয়েছেন মোট ১ হাজার ৪৩৯জন। ১ হাজার ৯১ সহকারী সচিবের মধ্যে ১০৩জন ওএসডি রয়েছেন।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত রাজনৈতিক কারণে প্রশাসনে কর্মকর্তাদের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করে রাখা হচ্ছে। আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কোনো ধরনের কাজ করানো ছাড়াই এদের পেছনে ব্যয় করা হচ্ছে বিপুল অঙ্কের সরকারি অর্থ।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান বলেন, ‘কোনো কারণ ছাড়া ওএসডি করে রাখলে প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দক্ষতা কমে যায়। তাদের পেছনে ব্যয় করা অর্থও রাষ্ট্রের সম্পদের অপচয়। এ সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।’

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার বলেন, ‘পদের চেয়ে কর্মকর্তাদের সংখ্যা বেশি হওয়ায় সবাইকে পদায়ন করা যাচ্ছে না। তাই সব সময় অনেক কর্মকর্তাকেই ওএসডি থাকতে হচ্ছে।’

সর্বশেষ গত ১০ সেপ্টেম্বর ৭২ উপসচিব পদোন্নতি পেয়ে যুগ্মসচিব হন। এর আগে ১৮ জুলাইও যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এ সময় পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব হন ৩৪৫ কর্মকর্তা। চলতি বছরের ১৪ মার্চ ২০৪ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিয়ে উপসচিব করা হয়।

এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আদালতে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। প্রতিবেদনে জনপ্রশাসনে ওএসডি কর্মকর্তাদের পেছনে পাঁচ বছরে সরকারের ব্যয়ের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়।

এতে বলা হয়, ২০০৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওএসডি কর্মকর্তাদের পেছনে ১০৩ কোটি ২৫ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৭ টাকা ব্যয় হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে করা ওএসডির মোট সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯৮৯।

গত বছরের ৩১ মে ওএসডির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এবং এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে জনস্বার্থে সাবেক সচিব এম আসাফউদ্দৌলা রিট আবেদনটি করেন। প্রাথমিক শুনানির পর ওই বছরের ৪ জুন হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ রুল জারি করেন। গত ১০ বছরে জনপ্রশাসনে ওএসডি করে রাখা কর্মকর্তাদের তালিকা, কত দিনের জন্য ওএসডি ছিলেন বা আছেন, তাদের পেছনে বেতনসহ কত টাকা ব্যয় হয়েছে তার বিবরণ দিতে বলেন আদালত।

পরে চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি ২০০৮ সালের আগের পাঁচ বছরেরও ওএসডি কর্মকর্তাদের তালিকা দাখিল করতে সরকারকে চার মাস সময় দেন হাইকোর্ট।

এরপর ১৯ মে আদালতে ২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ওএসডি করা কর্মকর্তাদের তালিকা উপস্থাপন করা হয়। এ সময়ে মোট ১ হাজার ৬১৬জনকে ওএসডি করা হয়। তাদের পেছনে সরকারের ব্যয় হয়েছিল ৪৭ কোটি ৬৫ লাখ ৯৩ হাজার ৪৭০ টাকা।

আদালতে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সব মিলিয়ে ২০০৪ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ওএসডি করা হয়েছে ৩ হাজার ৬০৫ কর্মকর্তাকে। এসব কর্মকর্তার পেছনে ৯ বছরে সরকারের মোট ব্যয় হয়েছে ১৫০ কোটি ৯১ লাখ ৫৮ হাজার ৭ টাকা।

(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/ সাদি/ এনডিএস/এইচএসএম/ডিসেম্বর ২১, ২১০৩)