আন্দোলনে নতুন মাত্রা দিতে যেকোনো সময় জোটের প্রধান ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজপথে নামতে পারেন। বিএনপির একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এছাড়া সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ ভূমিকার প্রত্যাশী দলটি এ সময় নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করতে রাজধানীতে শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে পারবে বলে বিশ্বাস করে। ফলে আন্দোলনের বিজয় অর্জন সহজ হবে। সেনাবাহিনী নামলে বিরোধী দলের কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করার সরকারের চেষ্টা শিগগিরিই থেমে যাবে বলেও দলটির বিশ্বাস। দেশব্যাপী সেনাবাহিনী টহলে নামলে তখন পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডারবাহিনী কথায় কথায় গুলি-হামলা চালাতে পারবে না বলে বিএনপি বিশ্বাস করে। তখন একটি নিরপেক্ষ আবহাওয়া দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরাজ করবে।

এ ব্যাপারে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর জেনারেল রুহুল আলম চৌধুরী দ্য রিপোর্টকে বলেন, শুধু সেনাবাহিনী নয়, পুরো সশস্ত্র বাহিনী আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। তারা সব সময়ই নিরপেক্ষ থেকে জাতীয় গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রুহুল আলম বলেন, সেনাবাহিনী যেহেতু সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে, সেজন্য সরকারের কিছু এ্যাসাইনমেন্ট তারা পালন করে থাকে, পালন করতে হয়। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী আগেও নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেছে। তবে, এভাবে একতরফা ও প্রতিদ্বন্দ্বীহীন এবং ভোটার বিহীন কোনো নির্বাচনে নয়।

জেনারেল আলম বলেন, যেহেতু সেনাবাহিনী আমাদের জাতীয় ঐক্যের প্রতীক, সেহেতু তাদের কাছে আমাদের আপিল থাকবে, তারা যেন কোনোভাবেই এ বিতর্কিত ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন সরকারের অবৈধ ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত না হয়। তাদের কাছে দেশের ১৬ কোটি জনগণের মতো আমরাও অতীতের মতো নিরপেক্ষতাই কামনা করি।

বিএনপি নেতারা মনে করেন ১৯৯৬ সালে বিএনপির করা ভুলের পথেই হাঁটছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি ১৫ ফেব্রুয়ারি একক নির্বাচন করে ভুল করেছিল। তখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল ৪৯জন। এখন ১৫৪জন। সে সময়ের করা ভুল বুঝতে দেরি করেছিল বিএনপি। তাতে আওয়ামী লীগ আন্দোলনকে সহিংস করতে পেরেছিল। সে আন্দোলনে বিজয়ী হয়েছিল আওয়ামী লীগ।

নিজেদের সে ভুল থেকে সৃষ্ট আওয়ামী লীগের সে সময়ের সেই আন্দোলনের ফসলই এবার বিএনপির প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে। বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে সে তখ্যই পাওয়া গেছে। তবে বিএনপির এবারের আ্ন্দোলনের সঙ্গে ৯৬ সালের আওয়ামী লীগের আন্দোলনের কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন না রাজনীতি সংশ্লিষ্টরা। আওয়ামী লীগের সেই আন্দোলনের মুল কেন্দ্র ছিল রাজধানী ঢাকা। এবারের আন্দোলনে বিএনপির নেতৃত্ব ঢাকায় টিকতে পারছেন না। অবরোধ দিয়ে ঢাকাকে দেশের অন্য জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলেও সরকারি দমন নীতির কারণে রাজধানীতে দাঁড়াতেই পারছেন না তারা। তবে সেনাবাহিনীর টহলের সময় রাজধানী ঢাকায় অবস্থান করতে পারবে। তাতে চূড়ান্ত বিজয়ের স্বপ্ন দেখছে দলটির নীতি নির্ধারণী নেতারা। সেক্ষেত্রে রাজধানীতে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার উপায় বের করেছে দলটি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ১৯৯৬ সালে আমরা (বিএনপি) ভুল করেছিলাম। বিএনপি ১৫ ফেব্রুয়ারি একক নির্বাচন করে ভুল করেছিল। তখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল ৪৯জন। এখন ১৫৪জন। ভুল বুঝতে বিএনপি দেরি করায় আওয়ামী লীগ আন্দোলনকে সহিংস করতে পেরেছিল। তারা গান পাউডার দিয়ে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মেরেছিল। ফিলিং স্টেশনে আগুন দিয়েছিল। ব্যাংকে আগুন দিয়েছিল। মানুষের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল। এক পর্যায়ে বিএনপি তাদের দাবি মেনে নিয়েছিল। তিনি বলেন, তখন আমরা যে ভুল করেছিলাম, আওয়ামী লীগ তার চেয়ে বড় ভুলের পথে রয়েছে। তারা বিএনপিসহ বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে বাধা দিচ্ছে। গণতান্ত্রিক কর্মসূচিকে সহিংস করে তুলছে। এরজন্য আওয়ামী লীগকে ফল ভোগ করতে হবে। প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ, ভোটকালীন সময়ে নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা, ঘোষিত দশম জাতীয় নির্বাচনের তফসিল বাতিল, পুনরায় তফসিল ঘোষণা, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, দলীয় নেতাকর্মীদের মুক্তিসহ বিভিন্ন দাবিতে চলমান আন্দোলন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন আন্দোলন কর্মসূচি দিয়েও এখন পর্যন্ত সফলতার পথে যেতে না পেরে কর্মসূচি নিয়ে পর্যালোচনা করছে বিএনপি ও ১৮ দল। এজন্য তাদের সাংস্কৃতিক সংগঠন, শ্রমিক সংগঠনসহ অন্য অঙ্গ সংগঠনগুলোকে আন্দোলনের মাঠে নামানোর চিন্তা করছে। সেজন্য জাসাসের মাধ্যমে দেশের প্রথিতজশা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে তারা সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যাবে। শ্রমিকদল বিভিন্ন সেক্টরে ধর্মঘট আহ্বান করবে।

জনগণকে আন্দোলনে বেশি করে সম্পৃক্ত করতে বিএনপির সাংস্কৃতিক সংগঠন জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা (জাসাস) সচেষ্ট রয়েছে বলে দাবি করেন সংগঠনটির সভাপতি এম এ মালেক। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা রাজপথ দখল করে আন্দোলন করেছে। সঙ্গে থেকেছে তাদের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো। এটা সত্যি। তবে, তখনকার পরিস্থিতি ও এখনকার পরিস্থিতি এক নয়। তৎকালীন বিএনপি সরকার বিরোধী দলের কর্মসূচির প্রতি সহনশীল ছিল। কোনো বাধাতো দিতোই না, বরং নিরাপত্তা দিত। কিন্তু এখনকার আওয়ামী সরকার বিএনপিকেই মাঠে নামতে দেয় না। বিনা নোটিশে গুলি করে দেয়। আমরা তো সংস্কৃতিকর্মী। আমাদেরও তারা ন্যূনতম কোনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে দেয় না।

১৯৯৬ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আদায়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা। সে সময় তারা টানা ১৭৩ দিন হরতাল কর্মসূচি পালন করেছিল। নেতাকর্মীরা রাজপথে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা সৃষ্টি করেছিল। রাজধানী ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কে ও বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্ররা মঞ্চ বানিয়ে, ট্রাকে অবস্থান নিয়ে আন্দোলন কর্মসূচি পালন করেছে।

আওয়ামী লীগের আন্দোলনে তাদের শ্রমিক সংগঠনগুলোও ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। দলের দাবি আদায়ে তারা কর্মক্ষেত্রে ধর্মঘট করেছে। বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে।

এছাড়া, আওয়ামী লীগের আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে তাদের অনুসারী সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিশেষ করে বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট রাজপথে নেমে এসেছিল। ঢোল-করতাল বাজিয়ে তারা গণজোয়ারমূলক গান ও পথ নাটকের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিল। কর্মসূচির সফল করতে দলের নেতাকর্মীরা সরাসরি মাঠে থেকে বাস্তবায়ন করেছে। প্রয়োজনে কঠোরতা অবলম্বন করেছে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, আওয়ামী লীগের সহিংসতার পথে যাব না আমরা। আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচির মাধ্যমেই দাবি আদায় করে ছাড়বো। আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চলছে। কর্মসূচি শান্তিপূর্ণই থাকবে। তিনি বলেন, সরকার আজকেই ঘোষণা দিক যে দেখামাত্রই গুলি চালাবে না তারা। তাহলে আজকেই ঢাকার রাজপথ কোটি জনতার দখলে চলে যাবে।

আজম আরও বলেন, আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি দিন দিন এমন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আর দখলে থাকবে না। কারণ জনগণের আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীরাও বলতে বাধ্য্ হচ্ছেন যে, শেখ হাসিনা গণপ্রজাতন্ত্রী ঢাকার প্রধানমন্ত্রী। দেশের নন। আন্দোলন এমন পর্যায়ে পৌঁছবে যে সেদিন আর দূরে নয়, শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হবেন।

বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জাফরুল হাসান দ্য রিপোর্টকে বলেন, শ্রমিক দল কোনো সভা-সমাবেশ করলেই তার ভিডিও ফুটেজ দেখে এই সরকার চাকরি খেয়েছে। নানাভাবে বল প্রয়োগ করেছে। আমাদের কাছ থেকে জোর করে স্বাক্ষর নিয়ে তাদের লোকদের সিবিএ নেতা হিসেবে ঘোষণা করেছে। কোনো লোক দেখানো নির্বাচনও তারা করেনি। এসব প্রতিকূলতার মাঝেও শ্রমিক দল বিএনপির দাবি আদায়ে ভূমিকা রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। চালিয়ে যাবে।

(দ্য রিপোর্ট/টিএস-এমএইচ/নূরুল/ডিসেম্বর ২১, ২০১৩)