জোসনা জামান, দ্য রিপোর্ট : পরামর্শক নিয়োগে দেরি হওয়া এবং জটিলতায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়ন। বিশেষ করে বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পে দেশি-বিদেশি পরামর্শকের কারণেই অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেরিও হচ্ছে। ফলে কোটি কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ার পাশাপাশি প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে।

এ পরিস্থিতিতে পরামর্শক নিয়োগে জটিলতার বিষয়টি কেস টু কেস পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নিলে ভবিষ্যতে এ ধরনের সমস্যা অনেকাংশে এড়ানো সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামছুল আলম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে বিলম্ব হওয়ার কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে যায়। আর এ কারণেই প্রকল্প ব্যয়ও বেড়েছে। বাড়তি টাকা ব্যয় করতে গিয়ে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা সরকারকে গচ্চা দিতে হয়। পরামর্শক নিয়োগ যাতে সময় মতো হয় সে জন্য প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সচেতন থাকা দরকার।’

আইএমইডির সর্বশেষ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উন্নয়ন প্রকল্পে বিশেষ করে কারিগরি দিকগুলোর বিষয়ে সমীক্ষা পরিচালনা এবং পরামর্শ দেয়ার জন্য অনেক প্রকল্পে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি নিয়োগের প্রয়োজন হয়। সে অনুযায়ী উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) সংস্থান রাখা হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই পরামর্শক নিয়োগে বিলম্বের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

এ ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় গৃহীত প্রায় সব প্রকল্পেই পরামর্শক নিয়োগের প্রয়োজন হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব যেমন স্থানীয় পর্যায়ে হয় তেমনি উন্নয়ন সহযোগী পর্যায়েও হয়ে থাকে।

পরামর্শক নিয়োগে জটিলতার কারণে বেশ কয়েকটি প্রকল্প অর্থছাড় ও ব্যয় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়)। শুধু পরামর্শক নিয়োগে দেরি হওয়ায় প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাল শেষ পর্যায়ে এলেও গুরুত্বপূর্ণ নির্মাণ কাজ শুরু করা যায়নি। ফলে প্রকল্প সংশোধন করতে হয়েছে এবং বাস্তবায়ন ব্যয়ও বেড়েছে।

এছাড়া আরও যেসব প্রকল্পের ক্ষেত্রে এ রকম ঘটনা ঘটেছে সেগুলো হচ্ছে- পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্প, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ইমার্জেন্সি ২০০৭ সাইক্লোন রিকভারি অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্ট, স্থানীয় সরকার বিভাগের ঢাকা পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্প ও আরবান পাবলিক অ্যান্ড হেলথ সেন্টার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্লিল ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট ও টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভোকেশনাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং রিফর্ম ইন বাংলাদেশ প্রজেক্ট, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের এস্টাবলিস্টমেন্ট অব সাসেক ইনফরমেশন হাইওয়ে প্রজেক্ট এবং ডেভেলপমেন্ট অব ন্যাশনাল আইসিটি ইনফ্রা-নেটওয়ার্ক ফর বাংলাদেশ প্রজেক্ট।

তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়) প্রথম ইউনিট প্রকল্পের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, দেশের উত্তরাঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকায় সেচের পানির অভাবে শস্যের ক্ষতি একটি চিরন্তন সমস্যা। শুস্ক মৌসুম ছাড়াও বর্ষাকালের পূর্বে ও বর্ষা পরবর্তী খরা প্রতিবছরের একটি নিয়মিত ঘটনা। এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য অন্যতম প্রক্রিয়া হিসেবে ভূ-উপরিস্থ পানি সেচ কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে তিস্তা নদীতে একটি ব্যারেজ নির্মাণের সিদ্ধান্ত আশির দশকে প্রথম গৃহীত হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী উত্তরাঞ্চলের ৫টি জেলা রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট ও নীলফামারীর ২২টি উপজেলায় প্রায় ৭ দশমিক ৫ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়ার লক্ষ্য ধরা হয়। কিন্তু এক সঙ্গে বিশাল এ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিবর্তে পর্যায়ক্রমে প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সে হিসেবে তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প-১ম পর্যায় ১৯৮০ থেকে ১৯৯৮ সময়ে বাস্তবায়িত হওয়ায় রংপুর, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলায় ১ লাখ ৫৪ হাজার হেক্টর এলাকা সেচের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরবর্তীতে কমান্ড এরিয়া উন্নয়ন নামে আরও একটি প্রকল্প ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাস্তবায়িত হওয়ার ফলে ১৯৯৩ সাল থেকে সীমিত সেচ সুবিধাসহ হালনাগাদ ৯১ হাজার ২৬৬ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়া সম্ভব হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়) গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

দ্বিতীয় পর্যায়ের এ প্রকল্পটি তিনটি ইউনিটে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এর মধ্যে প্রথম ইউনিটকে প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করে ২০০৬ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ অংশের ব্যয় ধরা হয় ২২৭ কোটি ২১ লাখ টাকা। ২০০৩ সালের ১২ জুলাই এটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) অনুমোদন লাভ করে। তার পর প্রকল্পের ব্যয় ও মেয়াদ বাড়িয়ে প্রথম সংশোধন করা হয়। ২০০৯ সালের ২৬ জানুয়ানি সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এ পর্যায়ে বাস্তবায়নকাল ছিল ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত। পরবর্তীতে আবারও দ্বিতীয় সংশোধনীর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে।

এ প্রকল্পটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা সমস্যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পরামর্শক নিয়োগে অস্বাভাবিক বিলম্ব। প্রকল্পের আওতায় বেশিরভাগ সেচ খাল ও সেকেন্ডারি সেচ খালের এলাইনমেন্ট নির্ধারণ, অবকাঠামো ডিজাইন প্রণয়নসহ ইত্যাদি কাজের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গাণিতিক মডেল স্টাডি ও টপোগ্রাফিক্যাল সার্ভে ফলাফলের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এ কাজের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে অস্বাভাবিক সময় লেগে যায়। ২০০৭ সালের ১০ এপ্রিল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও এর তিন বছর পর কার্যাদেশ দেয়া সম্ভব হয়েছে। ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল সিইজিআইএস পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটিকে কার্যাদেশ দিলেও তার দুই বছর পরও অর্থাৎ ২০১২ সাল পর্যন্ত সেকেন্ডারি খালের চূড়ান্ত এলাইনমেন্ট এবং জমি পরিকল্পনা পাওয়া যায়নি। ফলে অনেক কাজ শুরু করতেই লেগে গেছে ৫ বছর।

(দ্য রিপোর্ট/জেজে/এনডিএস/সাদিক/লতিফ/ডিসেম্বর ২১,২০১৩)