এমপি প্রার্থীদের এলাকাভীতি
সাহস জোগাতে কেন্দ্র থেকে টিম যাচ্ছে জেলায় জেলায়
আমানউল্লাহ আমান, দ্য রিপোর্ট : আর মাত্র ১৪ দিন পরই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিরোধীদলীয় জোটবিহীন এ নির্বাচনে এখনও দেখা যাচ্ছে না নির্বাচনী আমেজ। এলাকায় না গিয়েও নির্বাচনের আগেই অন্য কোনো প্রার্থী না থাকার কারণে অর্ধেক আসনে এমপি বনে গেছেন অনেকেই। যারা ইতোমধ্যে এমপি হয়েছেন আর যারা এমপি প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন- এই দুই ধরনের জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে এলাকাভীতি। এসব এমপিদের ও এমপি প্রার্থীদের সাহস জোগাতে আগামীকাল সোমবার কেন্দ্র থেকে ৪টি টিম যাচ্ছে ১১টি জেলায়।
নাশকতায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে এলাকায় যাওয়ার চেয়ে ঢাকায় থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন অনেকে। এদিকে এমপি প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে না পেয়ে বিরোধীদলীয় জোটের চলমান আন্দোলনে নাশকতার মুখে পড়ছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বারবার নির্দেশ দিয়েও এলাকামুখী করতে পারছেন না এমপি ও এমপি প্রার্থীদের। নির্বাচনী প্রচারে এবং বিরোধী জোটের নাশকতার ভীতি কাটাতে এবার দলটির কেন্দ্রীয় নেতারাই দল বেঁধে জেলা-উপজেলায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক ও এসএম কামাল হোসেনের নেতৃত্বে সাতক্ষীরা ও নড়াইল জেলা, সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে নীলফামারী, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা জেলা, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের নেতৃত্বে সিরাজগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী জেলা, আহমদ হোসেন ও এনামুল হক শামীমের নেতৃত্বে লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম জেলায় সফর করবে ক্ষমতাসীন দলের সাংগঠনিক টিমগুলো।
স্থানীয় নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করে সারাদেশে নির্বাচনী ঢেউ কিভাবে তোলা যায়, তা নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বুধ ও বৃহস্পতিবার দুটি বৈঠক করেছেন ১৪ দল ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে।
বৈঠক সূত্র জানায়, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা এবং নির্বাচনের আগে বিএনপি-জামায়াতের নাশকতা মোকাবেলা করাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে ভাবতে বলেছেন দলের নেতাকর্মীদের। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সর্বোচ্চ সাংগঠনিক শক্তি কাজে লাগানোর পরামর্শ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। একই সঙ্গে তিনি আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের নেতাদের নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় যেয়ে ভোটারদের পাশে থাকতে বলেছেন। জনসংযোগ করে ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে বলেছেন। এর আগে আওয়ামী লীগের ৭৩ সাংগঠনিক জেলার সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকদের দফায় দফায় ফোন করে এলাকায় নির্বাচনী প্রচার এবং বিরোধী দলের নাশকতা মোকাবেলার নির্দেশ দিয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা।
এরই ধারাবাহিকতায় গত শুক্রবার দলটির শীর্ষ নেতারা সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠক প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক দ্য রিপোর্টকে বলেন, বিএনপি-জামায়াত দেশকে অকার্যকর, জঙ্গী ও তালেবানী রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করছে। যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষা করতেই তারা এসব করছে। সবাইকে বিএনপি-জামায়াতের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে উৎসবমুখর করে তুলতে আগামী সোমবার থেকে জেলা সফরে বের হব আমরা। আমাদের দলের এবং সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের সমন্বয়ে বিভিন্ন টিম সোমবার থেকে শুক্রবার টানা ৫ দিন সাতক্ষীরা, নড়াইল, নীলফামারী, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, রাজশাহী, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম জেলায় সাংগঠনিক সফর করবে।
স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চাঁদপুর জেলার ৫টি আসনের এমপি প্রার্থীদের মধ্যে ২টি আসনে সাবেক দুই মন্ত্রী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দিপু মনি এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর নিজ আসনে গিয়েছেন হাতে গোনা কয়েকবার। সর্বশেষ ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর এলাকায় থেকে বিজয় দিবসের কর্মসূচি পালন করেছেন দিপু মনি।
মহীউদ্দীন খান আলমগীরের উপস্থিতিতে একটিরও বেশি নির্বাচনী সভা এখনও হয়নি তার আসনে। চাঁদপুর-৫ আসনের প্রার্থী মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর একবার এসেছেন এলাকায়।
চাদপুর-৩ আসনের প্রার্থী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। চাঁদপুরের চেয়ে ঢাকার মাঠে রাজনৈতিক কর্মসূচিতেই তাকে বেশি দেখা যায়।
কিশোরগঞ্জের ৬টি আসনের প্রায় সবটিতেই স্থানীয় নেতাকর্মীদের চেয়ে যোজনযোজন দূরে এমপি প্রার্থীরা। মনোনয়ন পাওয়ার পর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মাত্র একদিনের জন্য নিজ আসনের ভোটারদের মুখদর্শন করে এসেছেন।
এই জেলার দুটি আসনের এমপি প্রার্থী দুই রাষ্ট্রপতির ছেলে। সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ছেলে নাজমুল হাসান পাপন এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের ছেলে রেজওয়ান আহম্মদ তৌফিক দুজনই নিজ এলাকায় তেমন একটা যাননি। পাপন ঢাকাতেই ব্যস্ত সময় কাটান। তৌফিক কিশোরগঞ্জে থাকলেও নিজ নির্বাচনী আসনে তেমন একটা যান না।
তবুও এই জেলার ৬ আসনের ৫টিতেই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন ৫ জন এমপি। বাকি একটি আসনে নির্বাচন হবে ৫ জানুয়ারি। কিশোরগঞ্জ-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্র্থী হিসেবে সমর্থন দেওয়া হয়েছে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুকে। তিনিও এলাকায় জনসংযোগে যাচ্ছেন না বলে জানালেন স্থানীয়রা।
জামায়াত-বিএনপির নাশকতায় সাতক্ষীরার তৃণমূল নেতারা আক্রান্ত হলেও তারা এমপি প্রার্থীদের পাশে পাচ্ছেন না। সবচেয়ে বেশি নাশকতা হয়েছে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের সাতক্ষীরা-৩ আসনে। তিনি হেলিকপ্টারে চড়ে মনোনয়নপত্র কিনতে ও জমা দিতে গিয়েছিলেন। এরপর আর এলাকায় যাননি।
জানা যায়, গত শুক্রবার যশোর থেকে ২০-২৫টি মাইক্রোর বহর নিয়ে তিনি নিজবাড়িতে এসেছেন। সাতক্ষীরা সদরের এমপি প্রার্থীর পাশাপাশি সাতক্ষীরার অন্য আসনের প্রার্থীরাও নিজ সংসদীয় আসনের বদলে শহরে ঘোরাফেরা করে ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন। গ্রামের দিকে যেয়ে ভোট চাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না তারা।
একই অবস্থা জয়পুরহাটেও। জয়পুরহাট-২ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হয়েছে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন। এলাকার চেয়ে ঢাকার কর্মসূচিতেই সরব থাকেন তিনি। গাইবান্ধা জেলায় জামায়াত-শিবিরের সহিংসতা প্রতিরোধে হিমশিম খাচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
গাইবান্ধা-৫ আসন থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ফজলে রাব্বী মিয়া বিজয় দিবসের দিনও এলাকার নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছিলেন না। রাজশাহী-১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচিত হয়েছেন সাবেক শিল্পপ্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী। তার এলাকা জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন সহিংস হয়ে পড়লেও তিনিও দীর্ঘদিন ধরে এলাকার বাইরে।
চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় জামায়াত-শিবির সহিংসতা চালালেও তা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছে সেখানকার নেতারা। অথচ এ জেলায় রয়েছে আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা। তাদেরও অনেকেই এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। অনেকে আবার মাঝে মধ্যে এলাকায় যেয়ে নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নেন।
একই অবস্থা দেশের প্রায় প্রতিটি আসনে। তৃণমূল নেতাকর্মীরা যখন প্রতিপক্ষের হাতে মার খাচ্ছেন, নেতারা তখন ঢাকায়। দলীয় এমপি-মন্ত্রী এমনকি কেন্দ্রীয় নেতাদের খবর নেই নিজ নিজ এলাকার।
(দ্য রিপোর্ট/এইউএ/শাহ/এমডি/ডিসেম্বর ২২, ২০১৩)