জোসনা জামান, দ্য রিপোর্ট : জাপানের ৩৫তম ইয়েন লোন প্যাকেজে ৫ প্রকল্প অন্তর্ভূক্তির অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) থেকে এ অনুরোধপত্র পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, জাপান বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। সেই ধারাবাহিকতা নতুন লোন প্যাকেজে যুক্ত করতে এ প্রকল্পগুলো নির্ধারণ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের জাপান ডেস্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব মোস্তাফিজুর রহমান দ্য রিপোর্টকে বলেন, আমাদের অনুরোধের ব্যাপারে এখনো কিছুই জানায় নি। জাপান সাধারণত চুক্তি স্বাক্ষরের আগে কোন কিছুই জানায় না।

সরকারের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো হচ্ছে, বিদ্যুৎ বিভাগের আওতায় কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিএল) মাতারবাড়ী কোল ফায়ারড পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রজেক্ট, স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ইনক্লুসিভ সিটি গভর্নেন্স প্রজেক্ট, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) যৌথভাবে হাওর ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট এন্ড লাইভলিহুড ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এগ্রিকালচার ফাইন্যান্স প্রজেক্ট এবং বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড, তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড এবং কর্ণফুলি গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগে ন্যাচারাল গ্যাস ইফিসিয়েন্সি প্রজেক্ট।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখছে জাপান। স্বাধীনতার পর থেকে দেশটি নিরবচ্ছিন্নভাবে এদেশের অগ্রগতিতে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। ১৯৭২ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ঋণ ও বিভিন্ন প্রকার অনুদান মিলে জাপান প্রদান করেছে মোট ৯৩২ কোটি ২৫ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ঋণ হচ্ছে, ৫৯৫ কোটি ৪৬ লাখ ৭০ হাজার এবং অনুদান ৩৩৬ কোটি ৭৮ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। এককভাবে জাপান বাংলাদেশের সরবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী দেশ। তবে বৈদেশিক সহায়তার ক্ষেত্রে সকল উন্নয়ন সহযোগী দেশে ও সংস্থাসমূহের মধ্যে দেশটির অবস্থান তৃতীয়। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব বিষয় উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাপান বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ, অনুদান, কারিগরি সহায়তা, ঋণ মওকুফ অনুদান সহায়তা, ঋণ মওকুফ অনুদান সহায়তা প্রতিরুপ তহবিল, ঋন মওকুফ তহবিল এবং বৃত্তি ও প্রশিক্ষণ সহায়তা প্রদান করে। মূলত জাপান যেসব খাতে সহায়তা করে সেগুলো হচ্ছে- মানব সম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষা ও দারিদ্র দুরীকরণ, পরিবহন ও অবকাঠামো উন্নয়ন, পানি নিস্কাশন, কৃষি ও সেচ, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং শিল্প।

সূত্র জানায়, এ যাবৎ (২০১২ সাল পর্যন্ত) জাপানের কাছ থেকে ২০টি পণ্য সহায়তা ঋণ এবং ৭৮টি ঋণ চুক্তির বিপরীতে মোট ৫৭৯ কোটি ১৪ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা পাওয়া গেছে। এছাড়া ৬ কোটি ৯৮ লাখ মার্কিন ডলারের একটি সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিড চুক্তি সম্পাদিত হয়। এছাড়া আরো বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়নে প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে।

জাপানি ঋণ সহায়তায় বর্তমানে সড়ক যোগাযোগ, টেলিযোগাযোগ, পল্লী উন্নয়ন, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে মোট ১৬টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।

অনুদানের বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিবছর জাপান সরকার বাংলাদেশকে অনুদান ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে থাকে। দারিদ্র বিমোচন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জনে বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জাপান সরকার অবকাঠামো উন্নয়ন, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ, পরিবেশ উন্নয়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতের প্রকল্পে অনুদান সহায়তা দিয়ে আসছে। বর্তমানে জাপানি অনুদান সহায়তার আওতায় ৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। এছাড়া চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জন্য জাপান সরকারের বিবেচনার জন্য মোট ১৭টি অনুদান সহায়তা প্রকল্প প্রস্তাব জাপান দূতাবাসে পাঠানো হয়েছে। ২০১২ সালে জাপানের জাইকার সঙ্গে ৩টি প্রকল্পে অনুদান চুক্তি করা হয়েছে।

কারিগরি সহায়তা অংশে বলা হয়েছে, কারিগরি সহায়তা ও মানব সম্পদ উন্নয়ন, বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, জাপান ওভারসিজ কো-অপারেশন ভলান্টিয়ারস (জেওসিভি) প্রেরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে জাপান সরকার বাংলাদেশকে দীর্ঘ দিন থেকে সহায়তা প্রদান করে আসছে। বর্তমানে (২০১২ সাল পর্যন্ত) জাপানি কারিগরি সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় ১৫টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। জাপান সরকারের আহ্বানের প্রেক্ষিতে চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থেকে ৪৪টি কারিগরি সহায়তা প্রকল্প প্রস্তাব জাপানের বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবগুলো বিবেচিত হলে আগামীতে কারিগরি সহায়তার পরিমান আরো বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

ঋণ মওকুফ অনুদান সহায়তার বিষয়ে বলা হয়েছে, ১৯৭৮ সালের ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত আঙ্কটার্ড এর ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের অধিবেশনে উন্নয়নশীল দেশ সমূহের ঋণ মওকুফ করার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে মোতাবেক বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকে ১৯৮৮ সালের মার্চ পর্যন্ত জাপান সরকারের নিকট থেকে বাংলাদেশ যে ঋণ গ্রহণ করেছে এবং মূলধন ও সুদ বাবদ যে অর্থ পরিশোধ করেছে, জাপান সরকার উক্ত সমুদয় অর্থ ডিআরজিএ হিসেবে বাংলাদেশকে ফেরত দিচ্ছে।

জাপানি ঋণ মওকুফ তহবিলের (জেডিসিএফ) বিষয়ে বলা হয়েছে, জাপান সরকারের কাছ থেকে গৃহীত ঋণ সরাসরি মওকুফের জন্য ২০০৪ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশ ও জাপান সরকারের মধ্যে একটি বিনিময় নোট স্বাক্ষরিত হয়। ওই বিনিময় নোটের মাধ্যমে জাপান ঋণ মওকুফ তহবিল (জেডিসিএফ) হিসেবে মোট ১৫৮ বিলিয়ন জাপানী ইয়েন বা ৯ হাজার ১শ কোটি টাকা বাংলাদেশকে প্রদান করে। এ অর্থ ব্যবহার করে মোট ১০৬টি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে বর্তমানে ৫৬টি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন।

জাপান হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট স্কলারশীপ প্রোগ্রাম বিষয়ে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) কর্তৃক জাপান হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট স্কলারশিপ প্রোগ্রাম (জেডিএস) শীর্ষক একটি প্রকল্প ২০০১ সাল থেকে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মানবসম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিশ্রুতিশীল ও তরুন কর্মকর্তাদের জাপানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ বছর মেয়াদি মাস্টার্স কোর্সে অধ্যয়নের সুযোগ প্রদান এবং স্ব স্ব কর্মক্ষেত্রে তাদের অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ২০১২-১৩ অর্থবছরে আনুমানিক ২০ কোটি টাকার (২০২ মিরিলয়ন জাপানি ইয়েন) অনুদান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। ইতোমধ্যেই প্রকল্পের আওতায় ১৮৩ জন কর্মকর্তা মাস্টার্স কোর্স শেষ করে দেশে ফিরে এসেছেন। এ প্রকল্পটি ২০১৬ সাল পর্যন্ত বৃদ্ধির জন্য একটি সংশোধিত টিপিপি অনুমোদনের লক্ষ্যে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছিল।

(দ্য রিপোর্ট/জেজে/জেএম/ডিসেম্বর ২২, ২০১৩)