প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির নথি দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দিতে গড়িমসি করছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক।

জরুরিভিত্তিতে ব্যাংকটির পাঁচ শাখায় প্রায় দুই হাজার ৪৪০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির নথিপত্র তলব করা হলেও এখনো পর্যন্ত তা সরবরাহ করা হয়নি। ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপকরা নথিগুলো দিতে গড়িমসি করছেন।

সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখার হলমার্ক কেলেঙ্কারির বাইরে ওই পাঁচটি শাখায় এ ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক কর্মকর্তা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নথিগুলো যথাসময়ে সরবরাহ করা হলে ঋণ জালিয়াতির দায়ে ব্যাংকের সাবেক পরিচালনা পর্ষদসহ বর্তমান ব্যবস্থাপকদের অনেকে ফেঁসে যেতে পারেন- এ ভয়ে নথিগুলো সরবরাহ করা হচ্ছে না। জরুরিভিত্তিতে এসব গুরুত্বপূর্ণ ফাইল সরবরাহ না করলে তা গায়েব হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে।’

গত দুই ডিসেম্বর সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড সিইও প্রদীপ কুমার দত্তের কাছে জরুরিভিত্তিতে নথিগুলো সরবরাহের জন্য নোটিস পাঠানো হয়। দুদকের সিনিয়র উপ-পরিচালক মীর মোঃ জয়নুল আবেদীন শিবলী নথিপত্র তলব করে ওই নোটিস পাঠান। দুদকের এ কর্মকর্তা দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘যে নথিগুলো তলব করা হয়েছে তা এখনো আমাদের হাতে আসেনি।’

সূত্র জানায়, সোনালী ব্যাংকের পাঁচ শাখার মধ্যে লোকাল অফিসে প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা, বৈদেশিক বাণিজ্য করপোরেট শাখায় প্রায় ১০০ কোটি টাকা, চট্টগ্রামের লালদিঘি করপোরেট শাখায় প্রায় ৯০ কোটি টাকা, চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ করপোরেট শাখায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা এবং নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখায় প্রায় ৩৫০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির নথিপত্র চাওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে ব্যাংকের লোকাল অফিসে প্রায় এক হাজার ৬০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগে নয়টি প্রতিষ্ঠানের ফোর্সড লোন, রপ্তানি বিল, পিএডি ও আইবিপি সংক্রান্ত তথ্য ও রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- অলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ, কেএনএস ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ, ক্যাংসান ইন্ডাস্ট্রিজ লিঃ, এপেক্স উইভিং অ্যান্ড ফিনিশিং মিলস লিঃ, পদ্মা পলিকটন নীট ফেব্রিক্স লিঃ, পিপুসীড টেক্সটাইল লিঃ, থারমেক্স টেক্সটাইল, ইকো কটন মিলস এবং রহিমা ফুড করপোরেশন।

বৈদেশিক বাণিজ্য করপোরেট শাখায় প্রায় ১০০ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে দুটি প্রতিষ্ঠানের নথিপত্র সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। এর মধ্যে মেসার্স বেরিল এ্যাপারেলস লি. এর রফতানি বিল, বিএল, কমার্শিয়াল ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট, ইএক্সপি, ভাউচার, ফরোয়াডিং লেটার, রফতানি বিল সংশ্লিষ্ট বিটিবিএল নম্বর, এলসি মূল্য, বর্তমান অবস্থাসহ সকল তথ্য এবং মেসার্স ইউসুফ অ্যান্ড কোং এর বিপরীতে স্থাপিত স্থানীয় ডেফার্ড ক্যাশ এলসিসমূহ সংক্রান্ত দফতর প্রতিবেদন, একসেপটেন্স, পরিদর্শন প্রতিবেদন, প্রধান কার্যালয়ের অনুমোদনসহ অন্যান্য সকল নথি চাওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রামের লালদিঘি করপোরেট শাখায় প্রায় ৯০ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে ১৭টি প্রতিষ্ঠানের জমি বন্ধকী এবং ঋণ বিতরণসহ সকল রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হল- এভারেস্ট প্রাইভেট লিঃ, ইউরো এ্যাপারেলস লিঃ, এ্যাপারেল ফেয়ার লিঃ, মুক্তা এ্যাপারেলস লিঃ, লিবরা ফ্যাশন ওয়্যার লিঃ, বিউমন্ড গার্মেন্টস লিঃ, হোসেন এ্যাপারেলস লিঃ, মেসার্স একমি টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টস লিঃ, ইমন এ্যাপারেলস লিঃ, মডেল এ্যাপারেলস লিঃ, ইউনাইটেড ফ্যাশন লিঃ, ডিউড্রপস এ্যাপারেলস লিঃ, রোজেন্ট গার্মেন্টস লিঃ, কোব এসোসিয়েটস লিঃ, এমাইকো ফেব্রিক্স লিঃ, তন্নী নীট ওয়্যার লিঃ এবং মোসুমী টাওয়েলস লিঃ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের লালদিঘি করপোরেট শাখার ডিজিএম মনির আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দু’এক দিন হলো আমরা দুদকের চিঠি হাতে পেয়েছি। নথিগুলো সংগ্রহ করা হচ্ছে। নথি সংগ্রহ শেষ হলে আমরা তা ব্যাংকের প্রধান শাখায় পাঠাবো।’

চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ করপোরেট শাখায় প্রায় ৩০০ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের ২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সাল সময় পর্যন্ত এলটিআর এবং ফোর্সড লোন সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- ইমাম ট্রেডার্স, জাসমির ভেজিটেলব অয়েল লিঃ, একে এন্টারপ্রাইজ, মহিউদ্দিন করপোরেশন, কামাল এন্টারপ্রাইজ এবং অর্কিড ফ্যাশন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওই শাখার ডিজিএম নিজামউদ্দিন আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমাদের কাছে যেসব নথি চাওয়া হয়েছে তা আমরা প্রধান শাখায় পাঠিয়েছি। প্রধান শাখা থেকে নথিগুলো দুদকে সরবরাহ করা হবে।’

নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখায় প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে মেসার্স রূপসী গ্রুপের ২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সাল সময় পর্যন্ত সকল বিটিবি/ক্যাশ এলসি সংক্রান্ত প্রতিবেদন, দফতর প্রতিবেদন, রফতানি বিল সংক্রান্ত কমার্শিয়াল ইনভয়েস, ইএক্সপি, বিএল, ফোর্সড লোন ও নগদ সহায়তাসহ সকল নথি সরবরাহ করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময়ে উপ-পরিচালক মাহমুদুল হকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত নিরীক্ষা প্রতিবেদনটি চাওয়া হয়েছে। এ গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- রূপসী নীট ওয়্যার, রূপসী ফেব্রিক্স লিঃ, রূপসী এমব্রয়ডারি, রূপসী ডিজাইন অ্যান্ড প্রিন্টিংস এবং মেসার্স সালমান নীট কম্পোজিট লিঃ।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ওই শাখার ডিজিএম মোজাম্মেল হক দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দুদকের চিঠি আমরা পেয়েছি। নথিগুলো প্রধান শাখায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’

তলবকৃত ওই নথিগুলো ছাড়াও ২০১০ সাল থেকে ২০১৩ সাল সময় পর্যন্ত ব্যাংকের ওই পাঁচটি শাখার ওপর পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের পরিদর্শন রিপোর্টও চাওয়া হয়েছে।

তবে এ প্রসঙ্গে মুঠোফোনে বার বার চেষ্টা করেও সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড সিইও প্রদীপ কুমার দত্তের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি।

প্রসঙ্গত, সোনালী ব্যাংকের বঙ্গবন্ধু এভিনিউ করপোরেট, আগারগাঁও করপোরেট, ও গুলশান শাখায় হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্তাধীন রয়েছে।

(দ্য রিপোর্ট/এইচবিএস/নূরুল/এইচএসএম/ডিসেম্বর ২২, ২০১৩)