আহমদুল হাসান আসিক, দ্য রিপোর্ট : রাজধানী ঢাকায় সক্রিয় রয়েছে ছাত্রশিবিরের একাধিক প্রশিক্ষিত কমান্ডো উইং। এ তথ্য জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র। তবে পুলিশের এ তথ্য অস্বীকার করেছে ছাত্রশিবির।

গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য মতে, প্রতিটি উইংয়ে রয়েছে ১৫-২০ জন সদস্য। তারা রাস্তায় নামে মাথায় হেলমেট আর বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে। কমান্ডো স্টাইলে হঠাৎ আক্রমণ করে দোকানপাটে; নির্বিচারে গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এরপর স্বল্প সময়ে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়ে নিমেষেই জনসাধারণের সঙ্গে মিশে যায়।

জানা গেছে, কমান্ডো উইংয়ের এ টিমগুলো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এ টিমের সদস্যরা পরিকল্পিতভাবে তাণ্ডব চালায়। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ও শক্তিমত্তার প্রমাণ দিতেই প্রশিক্ষিত স্কোয়াড মাঠে নেমেছে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গত ১৩ ডিসেম্বর শুক্রবার জুমার নামাজের পর তাণ্ডব চালিয়েছে শিবিরের প্রশিক্ষিত কমান্ডো উইংয়ের সদস্যরা। রামপুরা, মতিঝিল, আরামবাগ, এজিবি কলোনি ও কমলাপুর এলাকায় ওই দিন বেশ কয়েকটি টিম মাঠে নেমে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটায়। এছাড়াও রাজধানীর একাধিক পয়েন্টে ধারাবাহিকভাবে মুহূর্তের মধ্যে সহিংস কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও যুগ্ম-কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে নাশকতার টার্গেট করে শিবিরের প্রশিক্ষিত সদস্যরা। তারা জঙ্গি স্টাইলে বিভিন্ন স্থানকে টার্গেট করে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে গোয়েন্দা তথ্য ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের তৎপরতায় তারা রাস্তায় বের হতে পারছে না।

মনিরুল ইসলাম বলেন, বিভিন্ন সময় দুই শতাধিক স্থানে নাশকতার পরিকল্পনা করে শিবিরকর্মীরা পিছু হটেছে। আগাম গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই পুলিশ ও গোয়েন্দারা নাশকতাকারীদের প্রতিরোধ করেছে। সম্প্রতি দুই-একটি স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটলেই তাদের কর্মীদের আটক করা হচ্ছে। তাদের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হয় না।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১০-১৫ জনের বেশ কয়েকটি টিম হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে কমান্ডো স্টাইলে মাঠে নামে। মুহূর্তের মধ্যে তাণ্ডব চালিয়ে পালিয়ে যায় শিবিরকর্মীরা।

মতিঝিল এজিবি স্টাফ কোয়ার্টারের বাসিন্দা ইকবাল করিম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে হঠাৎ দেখলাম একটি মোটরসাইকেলে চড়ে দুইজন মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের সামনের সড়কে নামল। আরোহী দুইজনের মাথায় হেলমেট ও গায়ে জ্যাকেট ছিল। তারা এক মিনিটেরও কম সময়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিস্ফোরণ ঘটিয়ে উধাও হয়ে যায়।

মিরপুরের বাসিন্দা মৌসুমী ইসলাম সাম্প্রতিক বাসে আগুনের একটি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে দ্য রিপোর্টকে বলেন, সিএনজিতে কারওয়ানবাজার সড়ক দিয়ে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে দেখলাম, হঠাৎ একটি মোটরসাইকেল থেকে কি একটা ছুঁড়ে মারা হলো। মুহূর্তের মধ্যেই একটি বাসের বাইরের অংশে আগুন ধরে যায়। আশপাশের সবাই ভীত ও হতবিহ্বল হয়ে দৌড়াতে শুরু করে।

গোয়েন্দা সদস্যরা জানান, হঠাৎ করে তাণ্ডব চালিয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা দেখে বোঝা যায় যে তারা প্রশিক্ষিত। কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়া এবং পরিকল্পনা ছাড়া একই স্টাইলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একাধিক এলাকায় এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। রাজধানীতে এর আগে এমন স্টাইলে নাশকতার ঘটনা ঘটেনি। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর রাজধানীতে নাশকতার উদ্দেশ্যে মাঠে নামছে প্রশিক্ষিত শিবিরকর্মীরা। ঝটিকা স্টাইলে রাজধানীতে এখন এভাবেই সহিংসতা চালাচ্ছে শিবির।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আ স ম ফিরোজ উল হাসান দীর্ঘদিন ধরে জামায়াত-শিবিরের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড এবং তাদের সামরিক কার্যক্রম সম্পর্কে গবেষণা করছেন। আ স ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, ‘আমি অনেক দিন ধরেই বলে আসছি জামায়াত-শিবিরের সামরিক শাখা আছে। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গত ১৩ ডিসেম্বর শুক্রবার জুমার নামাজের পর কমান্ডো স্টাইলে যে ভয়াবহ তাণ্ডব চালানো হয়েছে, তা যে ছাত্রশিবিরের সামরিক শাখা ঘটিয়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।’

তিনি আরো জানান, অরণ্যে শ্বাপদ নামক একটি বইয়ে জামায়াতের সামরিক শাখার কথা বলা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে- লেখক নিজে জামায়াতের সামরিক শাখার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারার পর জামায়াতের রাজনীতি থেকে সরে যান। এরপর তিনি এ বইটি লেখেন।

বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক জানান, ছাত্রশিবির দেশের পাহাড়ি অরণ্যে এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বল্প পরিসরে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ প্রশিক্ষণ তারা দেশের বাইরে থেকে নিয়ে আসে। বইয়ের লেখক বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন সামরিক শাখার নেতা হিসেবে।

জানা গেছে, নাশকতার উদ্দেশ্যে রাজধানীর বাইরে থেকেও প্রশিক্ষিত শিবিরকর্মীরা ঢাকায় আসা শুরু করেছে। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস ঘটনা ঘটাতে পারলেও অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে রাজধানীতে সফল হতে পারছে না। আর এতে রাজধানীতে বড় ধরনের নাশকতার ঘটনা ঘটানো এবং শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে অস্তিত্ব জানান দিতে বিভিন্ন এলাকা থেকে শিবিরকর্মীরা ঢাকায় আসছে।

কমান্ডো উইং সম্পর্কে জানতে চাইলে ছাত্রশিবিরের সাবেক দফতর সম্পাদক এ্যাডভোকেট হেলাল উদ্দিন দ্য রিপোর্টকে বলেন, যারা রাজধানীতে সেদিন তাণ্ডব চালিয়েছে তারা জামায়াত-শিবিরের কেউ না। আর শিবিরের এমন কোনো সহিংস উইং নেই।

(দ্য রিপোর্ট/এএইচএ/শাহ/এইচএসএম/নূরুল/ডিসেম্বর ২২, ২০১৩)