শেষ পর্যন্ত মহাজোটের শরীক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদই কাল হল আওয়ামী লীগের। নির্বাচন ও নির্বাচনকালীন সরকার থেকে হঠাৎ ইউটার্ন নেওয়ার পর জাপার কিছু প্রার্থী সরকারের বশ মানলেও, এরশাদ অনড় থাকায় বিপাকে পড়েছে আওয়ামী লীগ।

রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এরশাদের ইউটার্ন নেওয়ার ফলে নির্বাচনকালীন সরকার ও পুরো নির্বাচনই এখন শতভাগ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এরশাদ মানেই জাতীয় পার্টি। এরশাদ নেই মানে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে নেই। ১৮ দলীয় জোট এবং অন্যান্য বিরোধী দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা এমনিতেই নেই। সর্বশেষ নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে নির্বাচনের কফিনে শেষ পেরেক মেরে দিয়েছেন এরশাদ।

তবে এরশাদ নির্বাচনে অংশ না নিলেও জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘ কই জাতীয় পার্টি তো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তুমি এ বিষয়ে সৈয়দ আশরাফকে জিজ্ঞাসা করো। উনি ভালো বলতে পারবেন।’

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-উল-আলম লেনিন এ প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘এসব করে জাতীয় পার্টি নিজেদের হাসির পাত্র বানাচ্ছে।’

প্রসঙ্গত ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরীক দল হিসেবে অংশ নেয়। পরে জাপা থেকে জিএম কাদের মন্ত্রীত্বও গ্রহণ করেন। ২০১৩ সালের ১৮ নভেম্বর জাপা মহাজোট ত্যাগ করে আওয়ামী লীগের অধীনেই নির্বাচনকালীন সরকারে ৬ জন মন্ত্রী নিয়ে শপথ নেয়। এরপর হঠাৎ করেই ৩ ডিসেম্বর নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন জাপা চেয়ারম্যান এরশাদ। ডাকযোগে পদত্যাগপত্র পাঠান গণভবনে।

জাপা সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর এরশাদকে বার বার আওয়ামী লীগ নির্বাচনে থাকার অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু নির্বাচন বর্জনের সিদ্বান্তে অনড় থাকায় শেষ পর্যন্ত এরশাদকে ১২ ডিসেম্বর হাসপাতালে নেওয়া হয়। তখন জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে এরশাদ আটক বলে দাবি করা হয়, পরে এরশাদের মুক্তির দাবিতে সারাদেশে ব্যাপক পোস্টারও সাঁটা হয়েছে।

জাপার একাধিক নেতা দাবি করেন, সরকার জাপার প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারে বাধা দিয়েছে। অনেক আসনে জাপা প্রার্থীর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার আবেদনের পরও বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতীয় এমপি হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এরশাদ একই পদ্ধতিতে রংপুর ও ঢাকায় প্রার্থিতা প্রত্যাহারের আবেদন করলেও ঢাকা-১৮ আসনের মনোনয়নপত্র গ্রহণ হয় কিন্তু রংপুরের আবেদন গ্রহণ করেননি রিটার্নিং অফিসার।

এ প্রসঙ্গে জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য জিএম কাদের শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমি মন্ত্রী নেই। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য আবেদন করেছিলাম। সরকার গ্রহণ করেনি। আমি মন্ত্রীত্বের কোনো সুযোগ সুবিধা ভোগ করছি না। আমার বাসায় পতাকা নেই। এখন গেজেট প্রকাশ করা সরকারের দায়িত্ব।’

জাপা নেতাদের অভিযোগ রয়েছে, ২১ জন জাপা প্রার্থীকে সরকার বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি বানিয়েছে। আর ৬৩ প্রার্থীর মনোয়নপত্র প্রত্যাহার আবেদন গ্রহণ করা হয়নি। এই ৬৩ জনই এখন নির্বাচনে আছেন।

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমাদের চেয়ারম্যান নির্বাচনে নেই মানে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে নেই। আমাদের চেয়ারম্যান বলেছিলেন, সকল দল নির্বাচনে অংশ না নিলে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে অংশ নেবে না। উনি উনার কথা রেখেছেন। আমরা নির্বাচনে নেই। তাই জাতীয় পার্টির নামে কেউ নির্বাচনে থাকলে সেটা এরশাদ সমর্থিত হবে না। এটা হবে সরকার সমর্থিত।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমীন বেপারি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘এরশাদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়ে সরকারের যে ক্ষতি করেছে, এখন যদি এরশাদ নির্বাচনে ফিরেও আসে এ ক্ষতি পোষানোর কোনো সুযোগ নেই। এরশাদের কারণেই ১৫৪ জন প্রার্থী ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে যা নজিরবিহীন।’

তিনি বলেন, ‘এমনিতেই যে নির্বাচনে ৫২ শতাংশ লোক ভোটই দিতে পারছে না সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য থাকছে না। তারপর এরশাদ নির্বাচন বর্জন করায় এখন এটা আর নির্বাচন থাকছে না। ফলে দশম জাতীয় নির্বাচন হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছে।’

(দ্য রিপোর্ট/ সাআ/এইচএসএম/সাদিক/ডিসেম্বর ২৩, ২০১৩)