শহীদ আলতাফ মাহমুদ
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : সুরকার, সাংস্কৃতিক কর্মী, ভাষা সৈনিক ও স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদ আলতাফ মাহমুদ ১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মুলাদি উপজেলার পাতারচরে জন্মগ্রহণ করেন। বিখ্যাত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটির বর্তমান সুর তার করা।
নাজেম আলী হাওলাদার এবং কদ বানুর একমাত্র পুত্র সন্তান আলতাফ মাহমুদ। তার বোন বিখ্যাত নাট্যাভিনেত্রী শিমুল ইউসুফ।
সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ১৯৪৫-৪৬ সালে বরিশালের 'তরুণ মাহফিল'-এর একজন উৎসাহী কর্মী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিনটিতে বরিশাল শহরে যেসব বিজয় তোরণ নির্মিত হয়েছিল তার বেশ ক'টির শিল্পনির্দেশক ছিলেন তিনি। ওই দিন রাত বারোটা এক মিনিটে 'তরুণ মাহফিলের' পক্ষ থেকে স্বাধীনতা বরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রথম গানের কণ্ঠশিল্পী ছিলেন তিনি।
১৯৪৮ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে তিনি মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা পাশ করে বিএম কলেজে ভর্তি হন। পরে তিনি চিত্রকলা নিয়ে পড়তে ক্যালকাটা আর্টস স্কুলে যান। তিনি প্রসিদ্ধ ভায়োলিন বাদক সুরেন রায়ের কাছে সঙ্গীতে তালিম নেন। এছাড়া গণসঙ্গীত তাকে খ্যাতি এনে দেয়।
পরবর্তীতে তিনি পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। যুবলীগের সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের শিল্পী হিসেবে তিনি প্রথমদিকে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকায় আসেন এবং ধুমকেতু শিল্পী সংঘে যোগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি এই সংস্থাটির 'সঙ্গীত পরিচালক' পদে আসীন হন। এ সময় ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য বিভিন্ন জায়গায় গণসঙ্গীত গাইতেন।
১৯৫৪ সালের ৩০ মে ৯২/ক ধারা জারি করে পাকিস্তান শাসকচক্র অনেককেই গ্রেফতার করে। পুলিশের হুলিয়া মাথায় নিয়ে নিজামুল হক ও আলতাফ মাহমুদ বরিশালে গিয়ে আত্মগোপন করেন। ১৯৫৫ সালের ৬ জুন ধারাটি প্রত্যাহার করা হলে শিল্পীরা আবার প্রাকাশ্যে আসেন। আত্মগোপন অবস্থায় গান রচনা করেন, 'মেঘনার কূলে ছিল আমার ঘর/ হঠাৎ একটা তুফান আইয়া/ ভাইসা নিল তারে রে'। এই গানটি ভৈরবের এক জনসভায় তাকে ৭ বার, ১১ বার মতান্তরে ১৯ বার গেয়ে শোনাতে হয়।
১৯৫৪ সালে ভিয়েনা শান্তি সম্মেলনে আমন্ত্রিত হন কিন্তু করাচিতে পাকিস্তান সরকার পাসপোর্ট আটকে দেয়ায় তিনি যোগ দিতে পারেননি। এরপর ঠিক করেন করাচিতে ভাগ্য গড়বেন। করাচিতেই প্রথম চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার দিকে হাত বাড়ান আলতাফ মাহমুদ। ১৯৫৬ সালে আলতাফ মাহমুদ করাচি বেতারে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পরবর্তীকালে এই বেতার থেকে 'ইত্তেহাদে ম্যুসিকি' নামে দশ মিনিটের একটি অনুষ্ঠান প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন। আর এই অনুষ্ঠানের জন্য সঙ্গীত লেখা, গ্রন্থনা, সুরারোপ, সঙ্গীত পরিচালনা সবকিছু করেছেন তিনি।
তিনি ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত করাচিতে ছিলেন এবং ওস্তাদ আব্দুল কাদের খাঁ'র কাছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বিষয়ক তালিম নিয়েছিলেন। এছাড়া তিনি নৃত্য পরিচালক ঘনশ্যাম এবং সঙ্গীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্য্যের সহকারী হিসেবেও কাজ করেছেন। করাচি থেকে ঢাকা ফেরার পর মাহমুদ ১৯টি বিভিন্ন চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া, ক্যায়সে কাহু, কার বউ, তানহা, বেহুলা, আগুন নিয়ে খেলা, দুই ভাই, সংসার, আঁকাবাঁকা, আদর্শ ছাপাখানা, নয়নতারা, শপথ নিলাম, প্রতিশোধ, কখগঘঙ, কুচবরণ কন্যা, সুযোরাণী দুয়োরাণী, আপন দুলাল ও সপ্তডিঙ্গা প্রভৃতি। সঙ্গীতে প্রতিভা থাকলেও মাহমুদ ছবিও আঁকতে পারতেন।
করাচি থাকাকোলে রেডিও পাকিস্তানের সংবাদ পাঠক আফতাব আহমদের মাধ্যমে দেবু ভট্টাচার্যের সঙ্গে পরিচয় হয়। এখানে তিনি পেয়ে যান বিখ্যাত সুরস্রষ্টা, সঙ্গীতসম্রাট আলাউদ্দিন খানের হাতেগড়া ছাত্র ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন যন্ত্রশিল্পী তিমিরবরণ সরোদিয়াকে (১৯০৪-১৯৮৭)। তারই শিষ্য সঙ্গীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্য। তার প্রচেষ্টায় সে সময় করাচিতে থাকা বাংলার বিশিষ্ট শিল্পীদের গড়ে ওঠে শিল্পীগোষ্ঠী 'ইস্ট পাকিস্তান এসোসিয়েশন'। একই সময়ে করাচি প্রবাসী বাঙালিদের চেষ্টাতে প্রতিষ্ঠিত হয় করাচির 'নজরুল একাডেমি'।
১৯৬৪ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। এরপর পল্লী উন্নয়নের জন্য সরকারি প্রচারণামূলক ৩০টি গান রেকর্ডিং করেছিলেন। ১৯৬৬ সালের মধ্যেই শিল্পী আলতাফ মাহমুদ সুরারোপ, কণ্ঠদান এবং সঙ্গীত পরিচালনায় পূর্ণ প্রতিষ্ঠালাভ করেন।
১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারির ২১, ২২ ও ২৩ তারিখে পল্টন ময়দানে তাদের উদ্যোগে 'জ্বলছে আগুন ক্ষেতেখামারে' শীর্ষক গীতিনৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়। এই গীতিনৃত্যনাট্যের সঙ্গীত পরিচালনা করেন তিনি- অভিনয়ও করেন। তার সহশিল্পী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অলি আহমদ প্রমুখ।
১৯৬৯ সালে তিনি আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন, যেটি প্রথমত সুর করেছিলেন আব্দুল লতিফ। এই সুরটি জহির রায়হানের চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেয়া'য় ব্যবহৃত হয়।
১৯৭১ সালে বেহালা, তবলা, হারমোনিয়মের সাথে আলতাফ মাহমুদের হাতে উঠে আসে রাইফেল। শহরের যেখানেই মিছিল আর আলোচনা অনুষ্ঠান হয় সেখানেই আলতাফ মাহমুদ উপস্থিত থাকেন। শহীদ মিনারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিচালনা ও কণ্ঠদান করেন তিনি। সেই সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ঠিক বিপরীত দিকে ৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের বাসায় থাকতেন।
২৫ মার্চ হানাদার বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইনের টিনসেডগুলোতে আগুন লাগিয়ে দিলে পরদিন সকালে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। ২৭ মার্চ কয়েক ঘণ্টার জন্য কার্ফ্যু শিথিল হলে আলতাফ মাহমুদ সবাইকে নিয়ে কমলাপুরের বৌদ্ধবিহারে আশ্রয় নেন। সেখানে ১৮ দিন থাকার পর আবার চলে আসেন রাজারবাগের বাসায়। এ সময় সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের নির্দেশে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটি অপারেশনে অংশ নেন।
আগস্টের শেষ সপ্তাহে ঠিক করেন সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ঢাকা ত্যাগ করবেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করবেন। কিন্তু তার আগেই বন্দি হন হানাদারদের হাতে। তাদের প্ল্যাটুনের একজন গেরিলা পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হাতে মার খেয়ে আলতাফ মাহমুদের বাসার কাঁঠাল গাছের নিচে লুকিয়ে রাখা গোলাবারুদের কথা বলে দেন। ৩০ আগস্ট ভোরবেলা আর্মিরা প্রথমে আলতাফ মাহমুদের পুরো বাড়িটি ঘিরে ফেলে। এরপর কয়েকজন ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে, 'আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যায়?' আলতাফ মাহমুদ জবাব দিলেন, 'আমি'। এরপর আর্মিরা তাকে দিয়ে মাটি খুঁড়ে কাঁঠাল গাছের নিচে লুকিয়ে রাখা গোলাবারুদের ট্রাঙ্ক দুটি বের করে তাকে সঙ্গে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় শ্যালকের কাছে হাতে পরা একটা আংটি খুলে দিয়ে বললেন, 'এটা ঝিনু এবং শাওনকে দিও। ওদের জন্য তো কিছু রেখে যেতে পারলাম না। দেশের মানুষ আছে ওদের জন্য।' ঝিনু তার স্ত্রী আর শাওন মেয়ে। এরপর তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ তাকে নানান স্বীকৃতির মধ্য সন্মান জানানো হয়। তাকে ১৯৭৭ সালে একুশে পদক প্রদান করা হয়। সংস্কৃতিক্ষেত্রে অসামান্য আবদান রাখায় ২০০৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। এছাড়া তার স্মরণে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শহীদ আলতাফ মাহমুদ ফাউন্ডেশন।
তাকে নিয়ে বেশ ক’টি বই রচিত হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ রচিত ‘আলতাফ মাহমুদ’, মতিউর রহমান রচিত ‘আলতাফ মাহমুদ-এক ঝড়ের পাখি’ ও আসাদুল হক রচিত ‘আলতাফ মাহমুদ-রক্ত দিয়ে লিখে গেল জীবনের গান’। তাকে নিয়ে প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করেছেন সেন্টু রায়। এছাড়া নাসির উদ্দীন ইউসুফ নির্মিত ‘গেরিলা’ ছবিতে আলতাফ মাহমুদের জীবনের কিছু অংশ চিত্রায়িত হয়েছে।
(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/ডিসেম্বর ২৩, ২০১৩)