টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এডিপি সংশোধনে ধীরগতি
জোসনা জামান, দ্য রিপোর্ট : দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) সংশোধনের প্রক্রিয়া চলছে ধীরগতিতে। চলতি অর্থবছরে সর্বোচ্চ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (রিভাইজড এডিপি) তৈরির কাজ শুরু করেছিল পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক কাজ চলার সময়ই সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশে এর গতি থেমে যায়। তবে এ কারণে এডিপি কাটছাঁটের কাজ খুব বেশি পিছিয়ে যাবে না বলে মনে করছে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন পরিকল্পনা সচিব ভূঁইয়া সফিকুল ইসলাম। সোমবার তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, পরিকল্পনা মন্ত্রীর এ ধরনের নির্দেশের বিষয়ে আমার জানা নেই। শিগগিরই আমরা আরএডিপির নীতিমালা জারি করবো। সময় মতোই এডিপি সংশোধন করা হবে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা দ্য রিপোর্টকে বলেন, নভেম্বর মাসের শেষ দিকেই এডিপি সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল। এ লক্ষ্যে সংশোধিত এডিপির নীতিমালা তৈরি করা শুরু করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে বৈদেশিক সহায়তা অংশের সংশোধনের জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) আলাদাভাবে সিরিজ বৈঠকও করেছে। এ অবস্থায় বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এডিপি সংশোধন প্রক্রিয়া দ্রুত না করে ধীরেচল নীতি অনুসরন করা হচ্ছে। এ কারণে এডিপি সংশোধন অন্যান্য বছরের চেয়ে পিছিয়ে যাবে কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেটি এখনো বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা আশা করছি খুব বেশি পেছাবে না।
এডিপি সংশোধনের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অপর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে দ্য রিপোর্টকে জানান, বর্তমান রাজনীতি যে কোন দিকে যাচ্ছে তা বোঝা মুশকিল। এডিপি সংশোধন করতে গেলে অনেক কিছুই ভেবেচিন্তে করতে হয়। যেমন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর যদি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকে তাহলে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ না কমে বরং বাড়তেও পারে। তাছাড়া গত ৫ বছর যেসব খাতে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল সেগুলোতেও পরিবর্তন আসতে পারে। নতুন সরকার এসে নতুন খাতে গুরুত্ব নির্ধারণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে এডিপির বাস্তবায়ন বেড়ে যাবে। আর যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হয়ে অন্য কোন রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে তাহলে সংশোধিত এডিপিতে বরাদ্দ অনেক কমে যাবে এবং খাতভিত্তিক গুরুত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যাপক তারতম্য দেখা দেবে। এসব দিক বিবেচনা করে পরিকল্পনা মন্ত্রীর নিদের্শে এডিপি সংশোধনের কাজ বন্ধ রয়েছে। মন্ত্রী বলেছেন, এখন আরএডিপির কাজ করার দরকার নেই, দেখি পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। তবে নীতিমালা তৈরির কাজ শেষ হয়েছে বলেও তিনি জানান।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে (২০১৩-১৪) অর্থবছরের জন্য এযাবতকালের সর্বোচ্চ আকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি) বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যা টাকার অঙ্কে ৭৩ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ৪১ হাজার ৩০৭ কোটি, বৈদেশিক সহায়তা থেকে ২৪ হাজার ৫৬৩ কোটি এবং এই প্রথমবারের মতো যুক্ত হওয়া স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন থেকে ৮ হাজার ১১৪ কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থবরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর সঙ্গে এবারই প্রথম স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের জন্য প্রস্তাবিত বরাদ্দ (স্থানীয় মুদ্রায়) ৮ হাজার ১১৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা যোগ হওয়ার ফলে মোট এডিপির আকার এযাবত কালের সর্ববৃহত হয়েছে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দসহ এবছর এডিপিতে গত অর্থবছরে এডিপি’র চেয়ে বরাদ্দ বাড়ছে ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ। আর স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বরাদ্দ ছাড়া এডিপির বরাদ্দ বেড়েছে ১৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের এডিপিতে মোট প্রকল্প রয়েছে ১ হাজার ১৭৬টি। এর মধ্যে বরাদ্দসহ অন্তর্ভুক্ত প্রকল্প ১ হাজার ৪৬টি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব অর্থায়নের ১৩০টি প্রকল্প রয়েছে। তবে বরাদ্দসহ প্রকল্পের মধ্যে নতুন অনুমোদিত প্রকল্প রয়েছে ৫০টি। এছাড়া এডিপিতে সম্ভাব্য সমাপ্য প্রকল্পের সংখ্যা ধরা হয়েছে ৩০৫টি। এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ২৮১টি, কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১৬টি এবং জেডিসিএফ প্রকল্প হচ্ছে ৮টি। এডিপিতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) প্রকল্পের লিংক কম্পোনেন্ট হিসেবে রয়েছে ৪৪টি প্রকল্প। বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তির সুবিধার্তে বরাদ্দ ব্যতিরেকে প্রতিফলিত প্রকল্প রয়েছে ৩৪৬টি। বরাদ্দহীনভাবে সংযুক্ত অননুমোদিত নতুন ৬৬১টি প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে চলতি অর্থবছরের এডিপিতে।
১৭টি খাতে ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সে হিসেবে সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে পরিবহন খাতে। এ খাতের (সড়ক পরিবহন, সেতু-রেলওয়ে-নৌ ও বেসামরিক বিমান পরিবহন) মোট বরাদ্দ ১৫ হাজার ৩৭৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা, যা মোট এডিপির ২৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ৫৩ কোটি টাকা, তৃতীয় অবস্থানে থাকা শিক্ষা ও ধর্ম খাতে বরাদ্দ ৮ হাজার ৭৬৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।
এছাড়া অন্যান্য খাতের বরাদ্দ হচ্ছে কৃষি ৩ হাজার ৭২১ কোটি ১৮ লাখ, পল্লী উন্নয়ন ও পল্লী প্রতিষ্ঠান খাতে ৬ হাজার ৬২২ কোটি ৩৩ লাখ, পানি সম্পদ খাতে ১ হাজার ৭৩৪ কোটি ১১ লাখ, শিল্প খাতে ২ হাজার ৩১৩ কোটি ৯৬ লাখ, তৈল-গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদ খাতে ২ হাজার ২৫৫ কোটি, যোগাযোগ খাতে ৯০৩ কোটি ৪১ লাখ, ভৌত পরিকল্পনা-পানি সরবরাহ ও গৃহায়ন খাতে ৫ হাজার ৪৫৪ কোটি ৪৯ লাখ, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি খাতে ২০৮ কোটি ৫২ লাখ, স্বাস্থ্য-পুষ্টি-জনসংখ্যা ও পরিবার কল্যাণ খাতে ৪ হাজার ২৩৯ কোটি ৫৪ লাখ, গণসংযোগ খাতে ৭৪ কোটি ৯০ লাখ, সমাজকল্যাণ-মহিলা বিষয়ক ও যুব উন্নয়ন খাতে ৫৫৭ কোটি ৪৮ লাখ, জনপ্রশাসন খাতে ১ হাজার ৫২৩ কোটি ৯৮ লাখ, বিজ্ঞান-তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে ৭৫৭ কোটি ৬১ লাখ এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান খাতে ৩৭০ কোটি ৯ লাখ টাকা।
অন্যদিকে গত (২০১২-১৩) অর্থবছরের বাজেটে মূল এডিপির আকার ধরা হয়েছিল ৫৫ হাজার কোটি টাকা। পরবর্তীতে তা সংশোধন করে ৫২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছিল।
(দ্য রিপোর্ট/জেজে/জেএম/ডিসেম্বর ২৩, ২০১৩)