আরিফ সোহেল, স্পোর্টস এডিটর : নিরেট ক্রিকেটভক্তদের স্নায়ুক্ষয়ের জন্য ওয়ান্ডারার্সের টেস্ট ম্যাচের কয়েকটি বলই যথেষ্ট। ওখানে দক্ষিণ আফ্রিকা-ভারত যে মহাকাব্যিক ম্যাচটি খেলেছে; তা আট-দশটা ম্যাচের মতো ছিল না। তবে এটা ঠিক ১৩৭ বছরের টেস্ট ইতিহাসে এমন ম্যাচ ছিল না; তা কিন্তু নয়। সংখ্যা নেহাতই কম। রেকর্ডবুকে ওয়ান্ডারার্সের ম্যাচটি এখন ২ নাম্বারে। ড্র বিবেচনায় রানের হিসেবটা চতুর্থ ইনিংসের; দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের স্কোর এটি। চতুর্থ ইনিংসে রানের পেছনে ব্যাট চালিয়ে সর্বোচ্চ রান তুলেছে ইংল্যান্ড। ১৯৩৯ সালে ডারবানে এই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে স্বাগতিকরা তুলেছিল ৬৫৪/৫। জয়ের জন্য তাদের প্রয়োজন ছিল ৬৯৬ রান। ম্যাচটি নিষ্পত্তি হয়েছে ড্র-তে।

আগাগোড়া নাগরদোলায় চড়েছে ওয়ান্ডারার্স। বিশেষ করে শেষ দিন; সকালে-দুপুরে-বিকেলে; ক্ষণে ক্ষণে পাল্টেছে ম্যাচের রূপ। সবমিলিয়ে ম্যাচটি হয়ে ওঠেছে অপরূপা। অবিশ্বাস্য নাটকীয়তার মমতা জড়ানো ম্যাচটি ড্র হলেও ইতিহাস এটিকে বুক-পকেটে তুলে রাখবে যুগ যুগ।

উত্থান-পতনের বারুদে ঠাসা ম্যাচে এক পর‌্যায়ে ৪ উইকেট হাতে নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল ২১ বলে ১৬। ভারতের পয়ন্তর বিকেলে ঠিক তার ২ বল পর রাহানের সরাসরি থ্রোতে ডু প্লেসিস রানআউট। এখানেই থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। নিশ্চিত জয়ের বর্ণময় রূপ পাল্টে গেছে এক অসাধারণ ওই এক থ্রো থেকেই। অবিশ্বাস্যভাবে পরের ১৫ বলে আর রানই করতে পারেনি স্টেইন-ফিল্যান্ডাররা; ম্যাচ বাঁচাতে ঠাঁয় দাঁড়িয়েছিলেন। ম্যাচটি তাই শেষ পর্যন্ত ড্র। শেষ ওভারে প্রয়োজন ছিল ১৫ রান। ম্যাচের শেষ বলে ৬ মেরে দক্ষিণ আফ্রিকার ভক্তদের বুকে জ্বালা আরো কয়েকগুণ বাড়িয়েছেন স্টেইন।

বলগাহীন রথে চড়ে আগেও টেস্ট ক্রিকেট হতো; তবে সেখানে সময়ের ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না। আউট না হওয়া পর‌্যন্ত চলত ম্যাচ। কিন্তু ১৮৭৭ সাল থেকে পাল্টে গেছে নিয়ম। সেখান থেকেই ৫ দিনে স্বীকৃত টেস্ট ক্রিকেটের অভিযাত্রা শুরু। টেস্ট ক্রিকেটের অভিষেক ম্যাচে খেলতে নেমেছিল ইংল্যান্ড; প্রতিপক্ষ অস্ট্রেলিয়া। হাঁটি হাঁটি পা-পা করে ক্রিকেট পৌঁছে গেছে ১৩৭ বছরে। রবিবার পর‌্যন্ত ‌ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে ২১০৮। সুবিশাল সংগ্রহশালায় সবচে বেশি রান তাড়া করে জয় পেয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। তারা ৪১৮ রানের টার্গেট জয় করেছে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০০৩ সালে অ্যান্টিগুয়ায়। আর এর পরই দক্ষিণ আফ্রিকা। তারা টেস্টে ৪১৪ রান তাড়া করে জয় তুলে নিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে; তাও আবার ওয়াকা গ্রাউন্ডে; ২০০৮ সালে। ওই ম্যাচেও ডি ভিলিয়ার্স সেঞ্চুরি মেরেছিলেন। ফলে ভারতর বিপক্ষে চতুর্থ ইনিংসে ৪৫৮ রানের টার্গেটটি খুব অপরিচিত ছিল না। বলা যায় ইতিহাসের পথেই হাঁটছিল ডি ভিলিয়ার্সের দক্ষিণ আফ্রিকা। যদিও একটি শঙ্কা ছিল; টেস্টে ৪০০ প্লাস রান করে ম্যাচ জয়ের রেকর্ড রয়েছে মাত্র ২টি।

দক্ষিণ আফ্রিকার জয়ের সামানা নির্ধারণ হয়েছিল সাক্যুলে ৪৫৮ রান। চতুর্থদিন ১৩৮ রানে থাকা স্বাগতিকদের শেষ দিন প্রয়োজন ছিল ৮ উইকেটে ৩২০ রান। সকালের ভয়ানক ধাক্কা সামলে জয়ের টার্গেট নিয়ে দুর্দান্ত ছুটছিলেন ডু প্লেসিস-ডি ভিলিয়ার্স। অসাধ্য সাধন বলতে যা বুঝায়; তাই করতে যাচ্ছিল ওই জুটি। পঞ্চম উইকেটে তারা দেশের পক্ষে রেকর্ড গড়েছেন। ৬২.৩ ওভার উইকেট আগলে রেখেছেন তারা; তুলেছেন জুটিবদ্ধ ২০৫ রান। ১০৩ করা ডি ভিলিয়ার্স উইকেটে ছিলেন ২৩৯ মিনিট। আর ১৩৪ করা ডু প্লেসিস উইকেটে থিতু ছিলেন ৩৯৫ মিনিট। এই জুটিই নিশ্চিত জয়ের পথ রচনা করেছিল। হারা ম্যাচ জয়ে রূপান্তরিত করেছেন তারা। কিন্তু অন্যরা পারেননি; জয়ের বন্দরে দলকে তুলে নিতে।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ২০১২ সালে অ্যাডিলেডে হারা ম্যাচ ড্রতে রূপায়িত করেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখানেও ম্যাচের নায়ক ডু প্লেসিস-ডিভিলিয়ার্স জুটি। ম্যাচে দীর্ঘ ৪৬৬ মিনিট উইকেট কামড়ে পড়েছিলেন ডু প্লেসিস করেছেন ১১০ রান। ডিভিলিয়ার্স ছিলেন ৪৪৬ মিনিট; অথচ রান করেছেন মাত্র ৩৩। অস্ট্রেলিয়ার নাগালের জয় ড্র বানাতেই তাদের জুটিকর্মই যথেষ্ট ছিল।

ভারতের বিপক্ষে ক্রিকেটের চোকার্সখ্যাত দক্ষিণ আফ্রিকা বলেই হয়তো সহজতর জয় হাতছাড়া করেছে। দিনভর নাটক-মহানাটকে জমে ওঠেছিল ম্যাচটি। সকালে আলো পড়েছিল ভারতের ওপর। তারপর সারাদিন ডুপ্লেসিস-ডি ভিলিয়ার্সের ঠাণ্ডা মাথার মহাকাব্যিক দ্যুতি মাখানো ব্যাটিং। ভারতের অস্বাভাবিক উচ্চতার অনুকূল ম্যাচ; জয়ের বাসনাকে ব্যাটের ছোবলে ছোবলে রক্তনীল করে ফেলেছেন তারা। উল্টো ম্যাচ যখন দক্ষিণ আফিকার শতভাগ নিয়ন্ত্রণে; তখনই ক্রিকেট ক্যানভাসে ভেসে ওঠেছে দক্ষিণ আফ্রিকার সেই চোকার্স রূপ।

দিনক্ষণ হিসেব করলে ৭ বছর ৯ মাস পর আরেকটি অবিশ্বাস্য ম্যাচের সাক্ষী হয়েছে ওয়ান্ডারার্স। ২০০৬ সালে ১২ মার্চ এই মাঠেই অস্ট্রেলিয়ার ৪৩৪ রানের টার্গেট টপকে দক্ষিণ আফ্রিকা ওয়ানডেতে গড়েছে সবচে বড় জয়ের মহারেকর্ড। আবারও একটি সুযোগ এসেছিল নাগালের মধ্যে। না পারলেও রেকর্ড হয়ে রয়েছে ম্যাচটি।

(দ্য রিপোর্ট/এএস/সিজি/ডিসেম্বর ২৩, ২০১৩)