মাহাদীর কথিত অনুসারীরা হত্যা ও গুমের শিকার
কাজী জামশেদ নাজিম ও আহমদুল হাসান আসিক, দ্য রিপোর্ট : নৃশংসভাবে হত্যা ও গুমের শিকার হচ্ছেন ইমাম মাহাদীর কথিত অনুসারীরা। সর্বশেষ গত শনিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর গোপীবাগের ভাড়া বাসায় কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুকসহ ৬ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এর আগে খুলনায় মাহাদীর অনুসারী কথিত পীর তৈয়বুর রহমান (৬০) ও তার ছেলে মনিরকে (১২) জবাই করা হয়। তারও আগে মাহাদীর কথিত অনুসারী হোমিওচিকিৎসক আবদুল আজিজ গুম হন।
গোপীবাগ ও খুলনার হত্যাকাণ্ডের কৌশলে হুবহু মিল রয়েছে। একই স্থানে জবাই করা হয়েছে। তারা সবাই ইমাম মাহাদীর অনুসারী বলে বিভিন্ন স্থানে প্রচার-প্রচারণা করেছিল। ইসলাম ধর্মে কোরআন ও হাদিসের আলোকে নামাজ-রোজা আদায়ের বিরোধিতা করতো এ কথিত পীররা। লুৎফর রহমান ফারুকসহ ৬জনকে জবাই করার রহস্য উদঘাটান করতে গিয়ে এমনই তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এসব হত্যার ঘটনা উগ্রপন্থি মৌলবাদীরা ঘটিয়েছে। এর মধ্যে হরকাতুল জিহাদের সদস্যদের সন্দেহ করা হচ্ছে। কথিত পীর ডা. আজিজকে গুমের নেপথ্যে হরকাতুল জিহাদ সম্পৃক্ত ছিল বলে নিশ্চিত হয়েছিল গোয়েন্দারা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, কথিত পীর লুৎফর রহমান ফারুকসহ ৬জনকে হত্যার ঘটনায় উগ্রপন্থি মৌলবাদিরা জড়িত থাকতে পারে। অনেকের দৃষ্টিতে লুৎফর রহমান ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার পাশাপাশি ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে আসছিলেন। এই কারণে হয়ত তাকে হত্যা করা হয়েছে।
মনিরুল ইসলাম বলেন, এর আগেও এমন কথিত পীরদের জবাই করার ঘটনা ঘটেছে। গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ঈদুল আযহার আগে খুলনায় কথিত পীর তৈয়বুর রহমান ও তার ছেলে মনিরকে জবাই করা হয়। ওই ঘটনার সঙ্গে ফারুকসহ ৬জনকে জবাই করার কৌশলের হুবহু মিল রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকাররা সবাই ইমাম মাহাদীর অনুসারী হিসেবে একই ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল। খুলনার জবাই করার ওই ঘটনাটি মাথায় রেখে রাজধানীর ৬ হত্যার তদন্ত চলছে।
মনিরুল ইসলাম আরো বলেন, একই আদর্শের ব্যক্তি হোমিওচিকিৎসক ডা. আজিজ বছর কয়েক আগে গুম হন। সে সময় তদন্ত কর্মকর্তারা গুমের ঘটনাটিতে হরকাতুল জিহাদের সদস্যদের সম্পৃক্ততা পেয়েছিল। তবে লুৎফরসহ ৬জনকে হত্যার ঘটনায় হরকাতুল জিহাদের সদস্যরা জড়িত রয়েছে কিনা সে বিষয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
হত্যাকারীদের দুজন আগে মুরিদ হয়
জানা গেছে, খুলনায় নিহত কথিত পীর তৈয়বুর রহমানের বাড়িতে ইসলাম ধর্মীয় নানাবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে দু’জন লোক প্রায়ই আসতেন। ঘটনার দিন গত ৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় তারা আবার এসে তৈয়বুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। তৈয়বুর রহমানের স্ত্রী বিকেলে কেনাকাটা করে বাসায় ফিরে এসে স্বামী ও সন্তানের জবাই করা লাশ দেখতে পান। একই ঘটনা ঘটেছে কথিত পীর লুৎফর রহমানসহ ৬জনকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। এখানে হত্যাকারীদের দু’জন মুরিদ ছিল। তাদের সহযোগিতায় খুনিরা কিলিং মিশন সফল করে। ফারুকের মেয়ে মোসা. রুনু বলেন, হত্যাকারীদের দু’জন তার বাবার মুরিদ ছিল। একটি চক্রই এ হত্যার ঘটনার জড়িত রয়েছে কিনা সে বিষয় খতিয়ে দেখছে তদন্তকারী কর্মকর্তা।
রহস্যের জট খুলতে ডিবির তিন টিম মাঠে
ইমাম মাহাদীর প্রধান সেনাপতি দাবিদার লুৎফর রহমান ফারুকসহ ৬জনকে হত্যারহস্যের জট এখনো খুলেনি। তবে রহস্যের জট খুলতে গোয়েন্দা পুলিশের তিনটি টিম মাঠে নেমেছে। যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম বলেন, আলোচিত হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ভার রবিবার বিকেলে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ গ্রহণ করেছে। তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে পরিদর্শক আবুল খায়েরকে নিযুক্ত করা হয়েছে। তিনটি বিষয়কে সামনে রেখে তিনটি টিম মাঠে নেমেছে। পরিবারের পক্ষ থেকে ধর্মীয় মতবিরোধের কারণে হত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এই কারণটিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে। বাকি দুই কারণ হচ্ছে-সম্পত্তি বিরোধ ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব।
মাহাদী অনুসারীর বর্ষপঞ্জি
ইমাম মাহাদীর প্রধান সেনাপতি দাবিদার লুৎফর রহমান ফারুক মাহাদী বর্ষপঞ্জি তৈরি করেন। তার বক্তব্য অনুসারে এখন মাহাদী বর্ষ ৭৪ চলছে। মাসগুলো হল- মুহাম্মদ, নাহন, আদম, আব্রাহাম, য্যাকোব, রাম, কৃষ্ণ, দাউদ, গৌতম, মুসা, ঈসা ও সংযম। মুহাম্মদ, নাহন, আদম, আব্রাহাম, য্যাকোব, রাম ও সংযম ৩০ দিনে মাস। কৃষ্ণ, দাউদ, গৌতম, মুসা, ঈসা ৩১ দিনে মাস। চার বছর পর অধিবর্ষ, সেক্ষেত্রে রাম মাসে ১ দিন যোগ হয়। বছরের প্রথম মাসের নামকরণ করা হয়েছে ‘মুহাম্মদ।’ মাসটি বাংলা আশ্বিন-কার্তিক ও ইংরেজি অক্টোবর-নভেম্বর সময় নির্ধারণ করা হয়। ‘নাহন’ বাংলা কার্তিক-অগ্রাহায়ণ ও ইংরেজি নভেম্বর-ডিসেম্বর। ‘আদম’ অগ্রাহায়ণ-পৌষ এবং ইংরেজি ডিসেম্বর-জানুয়ারি, ‘আব্রাহাম’ বাংলা পৌষ-মাঘ ও ইংরেজি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি। এভাবেই প্রতিটি মাস নির্ধারণ করে ম্যাগাজিন পত্রিকা ‘ক্যাম্পাস টুডে’তে বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। ক্যাম্পাস টুডের ওই সংখ্যাটি দ্য রিপোর্টের সংগ্রহে রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত শনিবার সন্ধ্যায় গোপীবাগের ৬৪/৬ নম্বর বাড়ির দোতলাতে কথিত পীরের সঙ্গে তার ছেলে সারোয়ার ইসলাম, খাদেম মনজুর আলম, মুরিদ মুজিবুল সরকার, শাহীন ও রাসেলকে গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
(দ্য রিপোর্ট/ কেজেএন/ এএইচএ/ এইচএসএম/ নূরুল/ডিসেম্বর ২৩, ২০১৩)