নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন জনপ্রতিনিধিরা!
চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতাসীন সরকারের বর্তমান, সাবেক অনেক মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিরা এখন নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কিন্তু দলীয় অবস্থানের কারণে জনসম্মুখে কেউই এই বিষয়ে মুখ খুলতে পারছেন না। সম্প্রতি একাধিক বর্তমান, সাবেক মন্ত্রীর সঙ্গে আলাপকালে তারা এই প্রতিবেদককে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।
কিছুদিন আগেও গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা ময়মনসিংহ এলাকা থেকে নির্বাচিত এক মন্ত্রিপরিষদ সদস্যের বাসায় কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হতে চলেছেন। নির্বাচন নিয়ে তার মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মনটা ভালো না। দেশের অবস্থা ভালো নেই। এভাবে এমপি-মন্ত্রী হতে চাই না। কিন্তু দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। অনেক জনপ্রতিনিধির ওপর হামলা হচ্ছে। মানসিকভাবে অস্বস্তিতে আছি।’
আগামী ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের এই তফসিল ঘোষণার পরপরই প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট তা প্রত্যাখান করেছে। বিরোধী এই জোটটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সারাদেশে হরতাল অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি পালন করছে। এতে করে রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। তৃণমূল থেকে রাজধানীতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। সহিংতা থেকে বাদ যাচ্ছেন না জনপ্রতিনিধিরাও। নিরাপত্তাবলয়ের মধ্যেও তারা আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। এতে করে ভেতরে ভেতরে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা থাকলেও দলীয় অবস্থানের কারণে তারা মুখ খুলতে পারছেন না। তারা পড়েছেন উভয় সংকটে।
১৪ ডিসেম্বর সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর এমপির ওপর হামলায় ছয়জন নিহত হয়। সম্প্রতি নির্বাচন কমিশন বরাবর নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেছেন বর্তমান সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। এর আগে তিনি একবার দেশের বাইরেও হামলার শিকার হয়েছিলেন। ইনু ছাড়াও কুষ্টিয়া এলাকার একাধিক আওয়ামী লীগ প্রার্থী নির্বাচন কমিশনে নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেছেন বলে জানা গেছে।
‘একতরফা’ নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দলটির সিনিয়র-জুনিয়র অনেক নেতাই এখন বিব্রত। তারাও চান সবদলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। কিন্তু দলীয় হাইকমান্ড ও সভানেত্রীর সামনে তাদের এই অভিব্যক্তি প্রকাশ করার ‘সৎ সাহস’ যেমন নেই, তেমনি দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার কোন উপায় নেই।
প্রধানমন্ত্রীর নিজ জেলার পাশের এক জেলার সাবেক মন্ত্রীও ঘরোয়া আলোচনায় আগামী নির্বাচন নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। দিন দুয়েক আগে আওয়ামী সমর্থক প্রবাসীদের সঙ্গে আলোচনার সময় তিনি বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে বিএনপি না আসাতে কিছুটা অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। তারপরও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। দলের এমপি-মন্ত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ আছে। আপনারা যারা স্যুট-টাই পড়ে ঘুরছেন তারাও সতর্ক থাকবেন। আর মানুষের সঙ্গে কাজ করে একটু সাহস দেন।’
২০ ডিসেম্বর বড়াইগ্রাম উপজেলার ধানাইদহ ও লালপুর উপজেলার কদিমচিলান এলাকার নাটোর-পাবনা মহাসড়কে অবরোধের বাধার মুখে পড়েন পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। পাবনার ঈশ্বরদীতে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিদর্শন শেষে ওই সড়ক হয়ে ঢাকায় ফেরার পথে এ রকম দুই দফা হয়রানির কবলে পড়েন পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী। এমন পরিস্থিতিতে মন্ত্রী নিজেই পিস্তল উচিয়ে নিজ উদ্যোগে ডালপালা সরিয়ে সড়ক পরিষ্কার করে ঢাকায় ফিরে আসেন।
নেত্রকোনা-২ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আরিফ খান জয়। তার কাছে নির্বাচনের নিরাপত্তার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে সব সময় বাড়তি নিরাপত্তা নেওয়া হয়। আমাদের এখানেও নেওয়া হচ্ছে। অর্ধেক আসনে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে অনেক আসনে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। তাই অনেকে নিজেদের দলের শত্রুতার শিকার হওয়ার আশঙ্কা করলেও দলের ইমেজ রক্ষায় মিডিয়ায় নাম প্রকাশ করে মন্তব্য করতে রাজি নন।’
২০ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের বৈঠকেও কয়েকটি এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। অন্যদিকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকেও যেসব এলাকায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সেসব এলাকার প্রার্থীসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে সর্তকতার কথা জানানো হয়েছে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে। এই বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত র্যাব-এর মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমানের কাছে আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থীদের নিরাপত্তা বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘নির্বাচনে যে ধরনের নিরাপত্তার দরকার সেই প্রস্তুতি আমাদের আছে।’
প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে কী ধরনের নির্দেশনা আছে? জবাবে মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কাছে সবার নিরাপত্তাই গুরুত্বপূর্ণ।’
এই বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি পুলিশের আইজিপি হাসান মাহমুদ।
(দ্য রিপোর্ট/বিকে/এসবি/এইচএসএম/সাদিক/ডিসেম্বর ২৫, ২০১৩)