নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও মহাজোট সরকারের প্রশাসন সংস্কার ও আধুনিকায়ন কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি।

সরকারের মেয়াদ শেষ হলেও সরকারি চাকুরেদের জন্য করা খসড়া আইনটি যেমন আলোর মুখ দেখেনি, তেমনি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভালো কাজের জন্য পদক নীতিমালাও খসড়াতেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল ফাইলিং ব্যবস্থা, এসিআর এর বদলে এপিআর চালুর বিষয়ে নেই কোনো অগ্রগতি।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, প্রশাসন সংস্কার ও আধুনিকায়নে বর্তমান সরকার তৎপর্যপূর্ণ কোনো অবদান রাখতে পারেনি। পে-স্কেল, পদোন্নতিসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের অবদান আছে। প্রত্যাশা চেয়ে এটা অনেক কম।

প্রশাসন সংস্কারে গত পাঁচ বছরে সরকারের অনেক অর্জন আছে দাবি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুস সোবহান সিকদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, যে আইন ও নীতিমালাগুলো খসড়া আকারে আছে তা আগামীতে চূড়ান্ত করা হবে।

কর্মচারী আইনের খসড়া করতেই সময় পার

সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু কোনো সরকারই এ আইন প্রণয়ন করেনি। সরকারগুলো বিধি, নীতিমালা ও প্রয়োজনমতো নির্দেশনাপত্র জারি করে সরকারি কর্মচারীদের পরিচালনা করছে ও করেছে। এতে করে প্রশাসনে দলীয়করণ ব্যাপকতর হয়, বিষয়টি প্রকাশ্য রূপ পায়। এ অবস্থায় ২০০৩ সাল থেকেই সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট প্রণয়ন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই সময় আইনটির খসড়া হলেও আলোর মুখ দেখেনি।

এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও এ ধরনের আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেটাও বাস্তব রূপ পায়নি। বর্তমান সরকার আসার পর নতুন একটি আইন করার উদ্যোগ নেয়। ২০১০ সালে ‘গণকর্মচারী আইন (পাবলিক সার্ভেন্ট আইন)’ খসড়া প্রণয়ণ করা হয়। দুই বছর ধরে সভা-সেমিনার করে ও সাধারণ মানুষের মতামত নিয়ে এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। ওই খসড়া আইনে পরীক্ষার মাধ্যমে উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতির কথা বলা হয়। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তারা পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি পদ্ধতির ঘোরতর বিরোধিতা করেন। খসড়া চূড়ান্ত করার আগে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মতামত ও লিখিত সুপারিশ পাওয়া যায়। সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে এ আইন প্রণয়নের নামে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সিভিল সার্ভিস আইনটি প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় উপস্থাপনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখান থেকে আইনটি অনুমোদন হয়ে আসার পরিবর্তে গত বছর ‘সরকারি কর্মচারী আইন’ নামে নতুন একটি আইনের খসড়া আসে।

নতুন খসড়া আইনে কর্মচারীদের আউটসোর্সিং করার প্রস্তাব রয়েছে। খসড়া আইন অনুযায়ী সরকার যে কোনো সময় যে কোনো ব্যক্তিকে সচিব বা যে কোনো পদে নিয়োগ করতে পারবে। বর্তমানে মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়োগ দেওয়া হয় সবচেয়ে সিনিয়র সচিবকে। নতুন খসড়া আইন অনুযায়ী নিয়মিত সচিবদের মধ্যে থেকে যে কোনো সচিবকে সরকার মন্ত্রিপরিষদ সচিব নিয়োগ করতে পারবে।

কর্মচারী আইনে মেধা, জ্যেষ্ঠতা, প্রশিক্ষণ, পেশাগত দক্ষতাকে পদোন্নতির মূল ভিত্তি ধরা হয়। তবে পদোন্নতির জন্য লিখিত পরীক্ষার কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। অথচ সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টে লিখিত পরীক্ষা দিয়েই পদোন্নতি পাওয়ার বিধান রাখা হয়েছিল। এসব কারণে এ খসড়া আইনটিও বিতর্কের মুখে পড়ে। এটি এখনো চূড়ান্ত করা যায়নি।

এ বিষয়ে আবদুস সোবহান সিকদার বলেন, এ আইনটি চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। এ জন্য আমরা সরকারি সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি।

আলোর মুখ দেখেনি পদক নীতিমালা

জনপ্রশাসনে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিশেষ অবদানের জন্য সিভিল সার্ভিস পদক দেওয়ার উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। প্রেরণার মাধ্যমে কাজে গতি আনা ও ভালো কাজের স্বীকৃতির জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ জন্য একটি খসড়া নীতিমালাও করা হয়।

খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী, সাধারণ ও কারিগরি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ব্যক্তিগত, দলগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক এই তিন ক্যাটাগরিতে সিভিল সার্ভিস পদক দেওয়া হবে। প্রশাসনের সব শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী এ পদকের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এতে থাকবে স্বর্ণপদক, নগদ অর্থ ও সম্মাননা।

ব্যক্তিগত অবদানের জন্য সর্বোচ্চ ২১ ক্যারেটের স্বর্ণপদক ও এক লাখ টাকা, দলগত অবদানের জন্য স্বর্ণপদক ও পাঁচ লাখ টাকা এবং প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শুধু পদক ও সম্মাননাপত্র দেওয়া হবে। ব্যক্তিগত ও দলগত পুরস্কারের জন্য মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অধিদফতর, পরিদফতর, দফতর ও সংস্থায় কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান এ পুরস্কারের জন্য আবেদন করতে পারবেন। উদ্যোগটি প্রশংসনীয় হলেও নীতিমালাটি চূড়ান্ত হয়নি।

পদক নীতিমালার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বলেন, প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির সভায় উঠার পর কিছু সংশোধনীসহ এটি ফেরত পাঠানো হয়েছে। এটি পরবর্তীতে আবারো অনুমোদনের জন্য কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হবে।

ডিজিটাল ফাইল ব্যবস্থাপনা থাকলো প্রতিশ্রুতিতেই

বর্তমান সরকারের শুরু থেকেই ডিজিটাল পদ্ধতিতে ফাইল পরিচালনার কথা বলা হলেও এখনো কাগজের ফাইলে নোট লেখা থেকে শুরু করে স্বাক্ষর সবই হচ্ছে। নিচ থেকে ওপরে ফাইল চালাচালিও হচ্ছে এনালগ পদ্ধতিতেই। কোন একটি মন্ত্রণালয়কে ডিজিটাল ফাইল ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা যায়নি। যদিও ২০১৪ সালের মধ্যে সকল মন্ত্রণালয়কে এ পদ্ধতির আওতায় আনার ঘোষণা রয়েছে।

ডিজিটাল ফাইল ব্যবস্থাপনা চালু দূরে থাক সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কক্ষে কম্পিউটার থাকলেও অনেকেই সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার জানেন না। সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে সেপ্টেম্বরে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে ডিজিটাল নথি পরিচালনার লক্ষ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে। একই সঙ্গে সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগসহ অন্যান্য সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে ‘ডিজিটাল ফাইলিং’ পদ্ধতির নথি চালুর নির্দেশও দেওয়া হয়।

ডিজিটাল ফাইলিং সম্পর্কে বলা হয়, এর প্রথম পর্যায়ে মন্ত্রণালয়গুলোতে কম্পিউটারে পৃথক ডিজিটাল ফাইল খোলা হবে। পরে এ পদ্ধতি আন্তঃমন্ত্রণালয়ভিত্তিক করার পরিকল্পনা নেওয়া হবে। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের পৃথক কোড নম্বর থাকবে, ফাইলগুলোতেও দেওয়া হবে পৃথক কোড নম্বর। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে পৃথক সফটওয়্যার থাকবে। এ সফটওয়্যারের মাধ্যমে একটি বিষয়ে ফাইল খুলে নোট লেখা হবে। সার্ভারের মাধ্যমে নোটটি সহকারী সচিব বা সিনিয়র সহকারী সচিবের কাছ থেকে পর্যায়ক্রমে উপসচিব, যুগ্ম-সচিব হয়ে সচিব-মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী পর্যন্ত যাবে। ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা কোনো ফাইল খুঁজতে চাইলে সফটওয়্যারের ফাইল ট্র্যাকার ব্যবহার করে নির্দিষ্ট কোড নম্বর অনুযায়ী তা বের করতে পারবেন।

এ বিষয়ে সোবহান সিকদার বলেন, ডিজিটাল ফাইল ব্যবস্থাপনার জন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের এক হাজার ২০০ জন ও মাঠ প্রশাসনের ৮৩১ কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। আরো প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর বাকি কাজগুলো পর্যায়ক্রমে শুরু করা হবে।

এসিআর বদলে এপিআর এরও অগ্রগতি নেই

দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনে চালু হওয়া বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনের (এসিআর) পাশাপাশি ‘বার্ষিক কর্মকৃতি প্রতিবেদন (এপিআর)’ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেয় সরকার। নম্বর কমানো, ঘষা-মাজা করা, পক্ষাতিত্বের অভিযোগসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠায় সরকার এসিআর পদ্ধতি পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়।

এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর গত বছর সেপ্টেম্বরে সংশ্লিষ্ট সকল দফতরে এ বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়। চিঠিতে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।

নতুন এ পদ্ধতির বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় জানায়, জনপ্রশাসনের সকল কর্মকর্তা বছরের শুরুতেই নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তার কাছে একটি কর্ম পরিকল্পনা জমা দেবেন। বার্ষিক কর্মপরিকল্পনার মান উন্নয়নে নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা মতামত দিয়ে অধীনস্থ সহায়তা করবেন। মানসম্মত বার্ষিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তা সহায়তা করবেন। বছর শেষে এপিআর প্রাপক কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে নম্বর দেবেন। এপিআর প্রাপক কর্মকর্তা প্রাপ্ত নম্বরে সন্তুষ্ট না হলে পুনর্বিবেচনার আবেদন করতে পারবেন। তাতেও সুরাহা করতে না পারলে এপিআর প্রাপক কর্মকর্তা তা প্রদানকারী কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তার কাছে পুনর্বিবেচনার আবেদন করবেন।

মন্ত্রণালয়টির প্রবর্তিত কর্মকৃতিভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতিতে (পিবিইএস) কর্মসূচির আওতায় এ কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৩ সাল থেকে মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পর্যায়ে এবং ২০১৪ সাল থেকে দেশের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে এ ব্যবস্থা চালুর পদক্ষেপ থাকলেও এ বিষয়ে তেমন কোন অগ্রগতি নেই।

এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে উচ্চ শিক্ষা নীতিমালা ও বৈদেশিক প্রশিক্ষণ নীতিমালা যুগোপযোগী করার উদ্যোগ সফল হয়নি এখনো।

(দ্য রিপোর্ট/আরএমএম/সাদিক/এসবি/ডিসেম্বর ২৪, ২০১৩)