নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে আসন্ন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের হলফনামা প্রকাশে আওয়ামী লীগের আপত্তিকে অগ্রহণযোগ্য ও অপ্রাসঙ্গিক বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্টজনেরা।

তাদের মতে, প্রার্থীদের সম্পদের বিবরণী নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশে আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এতে হস্তক্ষেপ বা আপত্তি জানানো একেবারেই অন্যায় ও ভোটারদের মৌলিক অধিকার খর্ব করার শামিল।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে প্রার্থীরা তাদের হলফনামায় যে সম্পদের বিবরণী দিয়েছেন তা নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। এ তথ্য নিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলো একের পর এক প্রার্থীদের অতীত বর্তমানের সম্পদের তুলনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। গণমাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের সম্পদের বিবরণী প্রকাশিত হওয়ায় অস্বস্তি দেখা দিয়েছে তাদের মধ্যে। অনেকেই এ নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।

নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে আওয়ামী লীগের অনেক নেতার সম্পদ বেড়েছে কয়েক শ’ গুণ। আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, তাদের দলের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালানোর জন্যই বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব তথ্য নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে।

২০০৭ সালে সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সম্পদের বিবরণী ও শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ আট ধরনের তথ্য দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এসব তথ্য প্রকাশে নির্বাচন কমিশনেরও বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও প্রার্থীদের তথ্য প্রকাশ করেছিল তৎকালীন নির্বাচন কমিশন। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা এ নিয়ে আপত্তি তুলছেন এবার।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নেতৃত্বে দলের একটি প্রতিনিধি দল সোমবার নির্বাচন কমিশনে গিয়ে সম্পদের বিবরণী প্রকাশ নিয়ে আপত্তি জানান। আর আওয়ামী লীগের আপত্তির মুখে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ মঙ্গলবার সাংবাদিকদের জানান, প্রার্থীদের তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত আইনে কি বলা হয়েছে সেটি পর্যালোচনা করে দেখবেন তারা।

মহীউদ্দীন খান আলমগীর দাবি করেন, সম্পদের বিবরণ প্রকাশের জন্য আদালতের কোনো নির্দেশনা নেই। যেকোনো ব্যক্তির আয়কর দলিল একটি গোপনীয় বিষয় এটি একমাত্র দেখতে পারেন সংশ্লিষ্ট আয়কর কর্তৃপক্ষ ও প্রয়োজনে আদালত এবং নির্বাচন কমিশন। এর বাইরে ভিন্নতর কর্তৃপক্ষ (গণমাধ্যম) এসে যদি নির্বাচনের আগে কোনো মন্তব্য করেন তাহলে তা হবে নির্বাচনে অযথা হস্তক্ষেপ।

এ ব্যাপারে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ছহুল হোসাইন বলেন, ‘আদালতের রায়ে প্রার্থীর সম্পদের বিবরণী পাবলিকের কাছে প্রকাশ করতে বলা হয়েছে। এ তথ্য ভোটারদের কাছে প্রকাশের আইনই রয়েছে। তা বন্ধ করা হবে কেন?’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘হলফনামায় প্রার্থীদের সম্পদের বিবরণী প্রকাশে আওয়ামী লীগের আপত্তি জানানোর বিষয়টি অন্যায় ও অনাকাঙ্ক্ষিত। আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐহিত্যবাহী দলের পক্ষে এ ধরনের দাবি একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কেন তারা জবাবদিহিতার ব্যাপারে আপত্তি তুলেছেন তা কারো কাছে বোধগম্য নয়।’

তিনি বলেন, ‘সম্পদ বিবরণী প্রকাশ আদালতের নির্দেশনা। প্রার্থীদের সম্পদের তথ্য জানা ভোটারদের মৌলিক অধিকার। এটিকে কোনো আইন করে খর্ব করা যাবে না। আশা করছি নির্বাচন কমিশনও তাদের (আওয়ামী লীগের) অনুরোধ পালনে বিরত থাকবেন।’

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ও জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণ পর্ষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘যেহেতু আওয়ামী লীগ একটি বড় রাজনৈতিক দল। তাই তারা এ ধরনের আপত্তি জানাতেই পারে। আর নির্বাচন কমিশন যেহেতু রেফারির ভূমিকায় রয়েছে তাই ওয়েবসাইট থেকে হলফনামা তুলে নিতে পারে। এটা নৈতিক ডাইমেনশনের ব্যাপার।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘একটি দলের চাপে হলফনামা প্রকাশ বন্ধ করা হলে তা হবে দুর্নীতি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনকে উৎসাহিত করা। নির্বাচন কমিশন তা করবে না বলেই আমরা আশাবাদী। আর যদি তা করে, তাহলে ধরে নিতে হবে কমিশন সরকারের বি-টিম হিসেবে কাজ করছে।’

এদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে দলটির উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর কমিশনের ওয়েবসাইট থেকে হলফনামা প্রকাশে আপত্তি জানালেও প্রকাশের পক্ষে মত দিয়েছেন দলের আরেক উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

তিনি মঙ্গলবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, জনপ্রতিনিধিদের আয়-ব্যয়ের হিসাব হবে উন্মুক্ত (ওপেন বুক একাউন্ট)। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এটা প্রকাশ হওয়া উচিত।

(দ্য রিপোর্ট/ কেএ/ এসবি/ নূরুল/ ডিসেম্বর ২৪, ২০১৩)