বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট জটিলতা ও রাজনৈতিক সংঘাত ও নাশকতা বন্ধ না হলে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর অবরোধ আসতে পারে। বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিকসহ জাতিসংঘের শান্তি মিশনের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর উপরও এর প্রভাব পড়তে পারে।

নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট অংশ না নেওয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী নির্বাচন পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। তবে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অসন্তোষের বহির্প্রকাশ ঘটে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে। স্বাধীনতার পর এই প্রথম ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকরা বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য যায়নি। তবে বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আমন্ত্রণে বঙ্গভবনে উপস্থিত ছিলেন তারা।

বিজয় দিবসের পর সর্বপ্রথম ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানায়। এরপর এই ধরনের সিদ্ধান্তের কথা জানায় কমনওয়েলথ ও যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ মঙ্গলবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে এক বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, চীন, জাপান, ব্রাজিল, নরওয়ে ও জাতিসংঘের শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিকরা তাদের এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত এসব দেশের নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। একই সঙ্গে কূটনৈতিক দূতাবাস এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা জোরদারের অনুরোধ জানান।

সম্প্রতি রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগ ও পদক্ষেপগুলোকে বাংলাদেশের জন্য শুভ নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকগণ। তাদের মতে, দেশের প্রধান দুই দল নিজেদের মধ্যে সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারলে এবং চলমান সহিংসতা রোধে কার্যকরি পদক্ষেপের অভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কচ্যুতি ঘটতে পারে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল নিজেদের মধ্যে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারলে সংঘর্ষ ও সংঘাত বাড়তে থাকবে। এ ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ যেখানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সেখানে বিদেশিরা নিজেদের নিরাপদ ভাবার কোনো অবকাশ নেয়।’

ইমতিয়াজ বলেন, ‘সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা সরকার করতে না পারার কারণেই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কূটনীতিকরা তাদের নিরাপত্তা নিয়েও সরকারের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সব কিছু মিলিয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি না ঘটলে অর্থনৈতিকসহ অন্যান্য বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে অবরোধ আসতে পারে। আস্তে আস্তে বিদেশিদের সিদ্ধান্ত সেদিকেই যাচ্ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘একাদশ জাতীয় নির্বাচনে সমাধান সম্ভব হলে দশম নির্বাচন নিয়ে কেন সমঝোতা হবে না। সরকারের সদিচ্ছা থাকলে দশম নির্বাচনেই সমঝোতা সম্ভব। আর এক্ষেত্রে পূর্বশর্ত হলো ঘোষিত তফসিল বাতিল করে নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা। সময় এখনো রয়েছে, সমঝোতা হতে সময় লাগে মাত্র একদিন। সমঝোতা করতেই হবে, আজ হোক, কাল হোক আর পরশু হোক সমঝোতা তো করবেই।’

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. নুরুল আমিন বেপারী দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সরকারের গোয়ারতুমির কারণে ভারত ছাড়া একে একে সকল আন্তর্জাতিক বন্ধুকে হারাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী জাতীয় নির্বাচন যে আন্তর্জাতিক মহলে গ্রহণযোগ্য নয় তার প্রমাণ ইইউ, কমনওয়েলথ ও যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত। এটা সরকারের জন্য এক প্রকার সতর্কবার্তা।’

নুরুল আমিন বলেন, ‘এর আগেও ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে ইইউ নির্বাচন পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের পদাংক অনুসরণ করে বাকি পর্যবেক্ষকরাও একই সিদ্ধান্ত নেয়। এরপরই কিন্তু এক-এগারোর ঘটনা ঘটে। এবারও দেশ সেদিকে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।’

নুরুল আমিন বলেন, ‘দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরো সংঘাতময় হলে ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে। ইতোমধ্যে আমেরিকান একটি বায়ার (ক্রেতা গোষ্ঠী) বাংলাদেশের ইনভেস্ট না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে ফেরত গেছে। এরপর দেখা যাবে ইউএন মিশনে দায়িত্বরত সশস্ত্র বাহিনীর উপরও একটা প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো সরকার আন্তর্জাতিক মহলে বেশি বন্ধুহারা হলো।’

চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংঘাতে জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের দেওয়া প্রতিশ্রুতিগুলো বরখেলাপ হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

ড. ইফতেখার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘যে নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল অংশ নিচ্ছে না সেখানে পর্যবেক্ষক পাঠানোর কেনো প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ফাঁকা মাঠে গোল হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী এমন বক্তব্যকে গুরুত্ব দিয়েই বিদেশি পর্যবেক্ষকরা না আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পাশাপাশি কূটনীতিকরা পরিষ্কারভাবে নিজেদের নিরাপত্তার ব্যাপারেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এটা সরকার ও দেশের জন্য বিব্রতকর। হয়তো সরকার শব্দ চয়নের মাধ্যমে বিষয়গুলোকে উড়িয়ে দিচ্ছে কিন্তু এগুলো জাতির জন্য লজ্জার ও অপমানজনক।’

ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, ‘দুই দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা না হওয়ায় নাগরিকের মৌলিক অধিকারগুলো ক্ষুণ্ন হচ্ছে। মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারছে না এমনকি স্বাভাবিক মৃত্যুরও নিশ্চয়তা পাচ্ছে না। এসব বিষয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। এখনই ভবিষ্যত বাণী করা ঠিক হবে না। তারপরও পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে আন্তর্জাতিক যে কোনো সিদ্ধান্তই আসতে পারে।’

এ ব্যাপারে সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘নির্বাচনে যখন সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায়নি তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেন পর্যবেক্ষক পাঠাবে? আর দেশের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে কেউই নিরাপদে নাই। এসব কারণে আন্তর্জাতিক মহল থেকে চাপ আসবে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে না পারলে আন্তর্জাতিক অবরোধও আসতে পারে। তবে আপাতত এমনটি হওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’

(দ্য রিপোর্ট/এইচআর/এইচএসএম/সাদিক/ডিসেম্বর ২৫, ২০১৩)