দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : ‘মা তুমি কেমন আছ। আমার জন্মদিনে কেন আসলে না। আমি একা একা জন্মদিন পালন করেছি।’ মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর ফোনে মেয়ের সঙ্গে সর্বশেষ এ কথাগুলো বলেছিলেন সাংবাদিক আফতাব আহমদ। বাবার মৃত্যুর পর এ সব কথা বলে বারবার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন মেয়ে আফরোজা আহমদ বর্ণা।

রাজধানীর পশ্চিম রামপুরা ওয়াপদা রোডের নিজ (৬৩ নম্বর) বাসায় খুন হন ইত্তেফাকের সাবেক প্রধান আলোকচিত্রী আফতাব আহমদ। তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত আলোকচিত্রী।

নিজ বাসার তিনতলা থেকে বুধবার সকাল ১০টায় হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ ও পরিবারের সদস্যদের অনুমান, আফতাব আহমদকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করে পালিয়ে গেছে খুনিরা। তবে কী কারণে তাকে খুন করা হয়েছে, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

পুলিশের অনুমান, গাড়িচালক হুমায়ুন কবির তাকে খুন করে ঘর থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ নিয়ে পালিয়ে যায়। এর সঙ্গে জড়িত আছে রাজমিস্ত্রীও। ঘটনার পর হুমায়ুন ও ওই রাজমিস্ত্রীকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি বন্ধ আছে তাদের মোবাইল ফোন। এ কারণেই মূল সন্দেহের তীরটা তাদের দিকেই বলে জানিয়েছে পুলিশ।

মেয়ে বর্ণা ছাড়াও তার আরও একটি সন্তান রয়েছে। তার ছেলের নাম মনোয়ার হোসেন সাগর। সে যশোরে স্ত্রীসহ বসবাসরত ও একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কর্মরত। ২০১০ সালে আফতাব আহমেদের স্ত্রী মারা যায়।

ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. মারুফ আহসান বলেন, সন্ধ্যার পর থেকে রাতের যে কোনো সময় তিনি খুন হয়েছেন। পুলিশ খবর পেয়ে সকাল ১০টায় লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠায়।

তিনি আরও জানান, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। তার গলায় চাদর পেচানো ছিল। এ ছাড়া গলায় একটি দাগ পাওয়া গেছে।

এদিকে ময়না তদন্তের পর ঢামেকের সহকারী অধ্যাপক আখম সফিকুজ্জামান বলেন, ‘আফতাব আহমদকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে। তার গলায় কোনো কিছু দিয়ে শ্বাসরোধ করার চিহ্ন পাওয়া গেছে।’

বাসার গৃহকর্মী নাসিমা জানায়, সকাল ৮টার দিকে বাসায় এসে তালাবদ্ধ অবস্থায় পান। এরপর তিনি পাশের বিল্ডিংয়ে ভাড়াটিয়াকে অনুরোধ করেন ভেতরে কেউ আছে কিনা দেখার জন্য। তখন ওই ভাড়াটিয়া জানান, ভেতরে জিনিসপত্র এলোমেলো অবস্থায় আছে। কিন্তু কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এরপর সে নিহতের মেয়েকে ফোন করে বিষয়টি জানায়। মেয়ে বর্ণা ফোনে চেষ্টা করেও বাবাকে না পেয়ে গাজীপুর থেকে রামপুরার বাসায় আসেন। সেখানে এসে পুলিশের সহায়তায় তালা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে মেঝেতে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় আফতাব আহমেদের লাশ দেখতে পান।

আফতাবের দীর্ঘদিনের বন্ধু জহিরুল হক বলেন, ‘তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়নি। তার হাত-পা বেঁধে মাথায় আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে। আমি নিজে মাথায় আঘাতের চিহ্ন দেখেছি।’

তিনি আরও জানান, তার কোনো শত্রু ছিল না। তবে তিনি টাকা ব্যাংকে টাকা না রেখে বাসায় রাখতেন। এ কারণে তার চালক তাকে হত্যা করে টাকা নিয়ে যেতে পারে।

নিহতের মেয়ে বর্ণাও একই কথা বলেন। মেয়ে বলেন, ‘এই মাসের ১ তারিখ থেকে গাড়ির চালক হুমায়ুনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর চাল-চলনে প্রথম থেকেই সমস্যা ছিল। তাকে বাজার করতে দিলে সে টাকা চুরি করত এবং বাবার সঙ্গে খুবই বাজে ব্যবহার করত। এ নিয়ে কয়েকবার বাবার সঙ্গে কথা কাটাকাটিও হয়। এরপর বাবা হুমাযুনকে বাসা ছেড়ে দিতে বলেন। কিন্তু সে বাসা ছেড়েছে কিনা আমি জানি না। এখন মনে হচ্ছে সে বাবাকে খুন করে টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘খুব শিগগিরই চিকিৎসার জন্য তার ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। এ জন্য তিনি বেশ কিছু টাকা বাসায় রাখেন। এ ছাড়া বাবা ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালী’ বইয়ের লেখক স্বত্ব হিসেবে ১৫ লাখ টাকা পান। সে টাকাও বাসায় ছিল। আমর ধারণা, করছি এ কারণেই বাবাকে খুন করা হয়েছে। এ ছাড়া হুমায়ুনকে নিয়ে আসে কাজের বুয়া নাসিমার ছেলে নাসির। এর আগে নাসির বাবার গাড়িচালক ছিল। তাকে চুরির দায়ে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়।’

এ ঘটনায় গোয়েন্দা পুলিশ গৃহকর্মী নাসিমাকে আটক করেছে। তাকে ডিবির কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে পুলিশ বলছে কাউকে আটক করা হয়নি। এ সম্পর্কে রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কৃপাসিন্ধু বালা বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। আমরা কাউকে আটকও করতে পারিনি।’

বিখ্যাত ‘বাষন্তী’র আলোকচিত্রী তিনি

সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী আলোকচিত্রী ‘বাষন্তী’ আলোকচিত্রটি আফতাব আহমেদের হাতে তোলা। এই আলোকচিত্রটি এক নারীর, যার মাধ্যমে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষকে ফুটিয়ে তোলা হয়। এর মধ্য দিয়ে সারা বিশ্ব জানতে পারে বাংলাদেশে চরম দুর্ভিক্ষ চলছে। তবে এই আলোকচিত্রটি সমালোচিত হয়েছে। তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক দুর্লভ আলোকচিত্র তোলেন। তিনি ১৯৬২ সাল থেকে প্রায় ৪০ বছর ইত্তেফাক পত্রিকায় কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়া তিনি ২০০৬ সালে একুশে পদক পান। তবে ২০১০ সালে পদকটি বাসা থেকে হারিয়ে যায়।

নিসংঙ্গ আফতাব

২০১০ সালে স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি পুরোপুরি নিঃসঙ্গ হয়ে যান। ছোট ছেলে যশোর বসবাস করতেন। বড় মেয়ে থাকেন গাজীপুরে। মেয়ে বাবাকে মাঝে-মধ্যে দেখতে আসলেও ছেলে কখনোই খোঁজ নিত না বলে জানা গেছে।

এমনকি গত ২১ ডিসেম্বর তিনি জন্মদিন কাটিয়েছেন একা একা। মেয়ে স্টার কাবাব থেকে খাবার কিনে পাঠালেও বাসায় আসেননি।

(দ্য রিপোর্ট/এনইউডি-এএইচএ/এসকে/ডিসেম্বর ২৫, ২০১৩)