আলমগীর কবির
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : বিখ্যাত চিত্রপরিচালক, চলচ্চিত্র সংগঠক ও সাংবাদিক আলমগীর কবির ১৯৩৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাঙামাটি শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা আবু সাইয়েদ আহমেদ ও মা আমিরুন্নেসা বেগমের আদি বাড়ি বরিশাল জেলার বানারীপাড়ায়। আলমগীর কবির লেখাপড়া শুরু করেন হুগলি কলেজিয়েট স্কুলে। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় অনার্স পাস করেন। অনার্স পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই ১৯৫৭ সালের শেষদিকে লন্ডন চলে যান এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিক্সে বিএসসি ডিগ্রি নেন।
১৯৫৯ সালে লন্ডনে থাকাকালে তিনি ডেইলি ওয়ার্কার নামের বামপন্থী দৈনিক পত্রিকার রিপোর্টার হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। ১৯৬২-৬৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে চলচ্চিত্রের ইতিহাস, নন্দনকলা ও নির্মাণকৌশল বিষয়ে বেশ কয়েকটি কোর্স করেন। ১৯৬৬ সালে দেশে ফিরে ইংরেজি পত্রিকা দ্য অবজারভার, পরে সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকায় সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে এক্সপ্রেস নামে একটি ট্যাবলয়েড সাপ্তাহিকে জহির রায়হানের সঙ্গে সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এ সময় তিনি কঠোর ও বিশ্লেষণধর্মী চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে সুপরিচিত হন। পরে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি থেকে তিনি সৈয়দ মোহাম্মদ পারভেজ পুরস্কার লাভ করেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ইংরেজি বিভাগের প্রধান হয়ে কাজ করেন। আহমেদ চৌধুরী ছদ্মনামে তিনি ইংরেজি খবর ও কথিকা পাঠ করতেন। একই সময়ে প্রবাসী সরকারের প্রধান প্রতিবেদক হিসেবেও কাজ করেন। সেই সময় তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে যুক্ত হন। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম নিয়ে জহির রয়হানের স্টপ জেনোসাইড প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে কাজ করেন। পাশাপাশি নির্মাণ করেন লিবারেশন ফাইটার্স নামের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র।
লন্ডন থাকাকালে তিনি ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। লন্ডনে ইস্ট পকিস্তান হাউস, ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট প্রভৃতি সংগঠন গড়ে তোলেন এবং ক্যাম্পেইন এগেইনস্ট রেসিয়াল ডিসক্রিমিনেশন আন্দোলনে সক্রিয় হন। ডেইলি ওয়ার্কারের জন্য কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সাক্ষাৎকার নেন। ব্রিটিশ পাসপোর্ট নিয়ে ফিলিস্তিনের মুক্তিযুদ্ধে শরিক হন। একই সময়ে তৎকালীন ফরাসি উপনিবেশ আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ফরাসি সরকারের হাতে ধরা পড়ে কয়েক মাস জেলে আটক ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি দেশে ফিরে বাংলাদেশে বামপন্থী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এক পর্যায়ে আইয়ুব সরকার তাকে গ্রেফতার করে জেলে রাখে। জেল থেকে বেরিয়েও এক বছর তিনি নজরবন্দি থাকেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকারের তথ্য বিভাগ থেকে তোলা নিউজ রিল ও ফুটেজ ব্যবহার করে তিনি নির্মাণ করেন প্রোগ্রাম ইন বাংলাদেশ বা বাংলাদেশ ডায়েরি নামে প্রামাণ্যচিত্র। অন্য কয়েকটি তথ্যচিত্রের চিত্রনাট্য, ধারাবর্ণনা রচনা করেন ও কণ্ঠ দেন। তার আরও কয়েকটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হলো কালচার ইন বাংলাদেশ, সুফিয়া, অমূল্য ধন, ভোর হলো দোর খোল, আমরা দুজন, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে, মণিকাঞ্চন ও চোরাস্রোত। তার নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হলো—ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩), সূর্যকন্যা (১৯৭৬), সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭), রূপালী সৈকতে (১৯৭৯), মোহনা (১৯৮২), মহানায়ক (১৯৮৪) ও পরিণীতা (১৯৮৫)।
চলচ্চিত্র বিষয়ে আলমগীর কবির বেশ কয়েকটি বই রচনা করেন- ফিল্ম ইন ইস্ট পাকিস্তান, ফিল্ম ইন বাংলাদেশ, সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে ও মোহনা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া ধীরে বহে মেঘনা ও দিস ওয়াজ রেডিও বাংলাদেশ ১৯৭১ নামে তার দুটি চিত্রনাট্য আছে।
তার প্রায় সব ছবিই কোনো না কোনো পুরস্কার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ধীরে বহে মেঘনার পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি এবং জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। সূর্যকন্যা চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। সীমানা পেরিয়ে চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে রূপালী সৈকতে চলচ্চিত্রের জন্য বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার লাভ করেন। মোহনা চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য রচয়িতার পুরস্কার পান। মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ওই চলচ্চিত্রের জন্য ডিপ্লোমা অব মেরিট লাভ করেন। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে পরিণীতা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সংসদ পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭৮ সালে। ২০১০ সালে তিনি সংস্কৃতি বিভাগে বাংলাদেশে স্বাধীনতা পুরস্কার পান করেন।
তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি শক্তিশালী চলচ্চিত্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৬৭ সালে তিনি পাকিস্তানের একমাত্র চলচ্চিত্র সংগঠন পাকিস্তান চলচ্চিত্র সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। মতানৈক্যের কারণে ১৯৬৯ সালে নিজস্ব উদ্যোগে তিনি গড়ে তোলেন ঢাকা সিনে ক্লাব। একই বছর প্রকাশিত হয় চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রথম বই ‘সিনেমা ইন পাকিস্তান’ এবং তার সম্পাদনায় সিনে জার্নাল সিকোয়েন্সের প্রথম সংখ্যা। সেই বছরই তিনি গড়ে তোলেন ঢাকা ফিল্ম ইনস্টিটিউট নামে বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র বিষয়ক প্রতিষ্ঠান। মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, মানজারে হাসীন মুরাদ, তারেক মাসুদ, শামীম আখতার, আখতারুজ্জামান প্রমুখ তার ছাত্র ছিলেন।
মুনিরা মোরশেদ মুন্নীর বই ‘চলচ্চিত্র আচার্য আলমগীর কবির’। আলমগীর কবির এবং তার কাজ নিয়ে সাক্ষাৎকার, চলচ্চিত্রের ফুটেজ, তার লাইভ ফুটেজ নিয়ে পরিচালক কাওসার চৌধুরী ২০০৮ সালে নির্মাণ করেন প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘প্রতিকূলের যাত্রী’। এ ছাড়া তাকে নিয়ে কিছু বইও রচিত হয়েছে। আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্রের মধ্যে সীমানা পেরিয়ে, সূর্যকন্যা এবং মহানায়ক বাজারে ডিভিডি আকারে পাওয়া যায়। তার নামে ঢাকার ধানমন্ডিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আলমগীর কবির চলচ্চিত্র কেন্দ্র।
১৯৬৮ সালে তিনি বিয়ে করেন মনজুরা বেগমকে। ছাড়াছাড়ির পর অভিনেত্রী জয়শ্রীকে বিয়ে করেন। তিনি কন্যা সন্তানের জনক।
১৯৮৯ সালের ১৯ জানুয়ারি একটি চলচ্চিত্র সংসদের উদ্বোধন ও আবু সাইয়ীদ নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আবর্তনের প্রদর্শনীতে বগুড়ায় যান আলমগীর কবির। পরের দিন ২০ জানুয়ারি দুপুরের পর গাড়ি চালিয়ে ঢাকায় রওনা হন। সন্ধ্যায় নগরবাড়ী ঘাটে ফেরিতে ওঠার জন্য পন্টুনের একপাশে অপেক্ষা করছিলেন। একটি ট্রাক ব্রেক ফেল করে তার গাড়িটাকে ধাক্কা দিয়ে পানিতে ফেলে দেয়। সেই দুর্ঘটনায় একই গাড়িতে থাকা আরও কয়েকজনসহ মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/ডিসেম্বর ২৬, ২০১৩)