রাসূলের খুতবা
মুসলিম ও অমুসলিমের মানবিক অধিকার
এ কে এম মহিউদ্দীন
ইসলাম শুধু একটি শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সবার জন্যই এটি সমানভাবে প্রযোজ্য। কেননা জগতে ইসলামের নাজিল হওয়ার প্রধান হেতু হচ্ছে, শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। আর শান্তি প্রতিষ্ঠিত হতে পারে একমাত্র পারস্পরিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন হলে। আর এই অধিকার প্রতিষ্ঠা করা গেলেই মানবতারই জয় হবে সুনিশ্চিত। এ কারণে কুরআন মজিদে বলা হয়েছে একমাত্র আল্লাহ্র কাছে মনোনীত ধর্ম ব্যবস্থা হচ্ছে, ইসলাম। আর দুনিয়াতে ইসলামের নবী রাসূল মুহাম্মদ (সা.)-কে প্রেরণ করা হয়েছে ইসলামের রহমত স্বরূপ। এ কারণে তিনি তার পুরো জীবনটাই নিবেদন করেছে মানবতার কল্যাণের জন্য। আজ আপনাদের সামনে তারই প্রমাণ স্বরূপ আমরা পেশ করছি মহানবীর ক্ষুদ্র দুটি ভাষণ। এর একটিতে প্রতিফলিত হয়েছে মানুষের প্রতি দরদি মনের অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অপরটি প্রাণীর প্রতি উদারনৈতিকতার দৃষ্টিভঙ্গি। এ থেকে বোঝা যাবে তিনি কতটা মানবতার জয়গান গেয়েছেন।
হজরত আবু হুরাইয়ার (রা.) বর্ণনা থেকে জানা যাচ্ছে, একদা তিনি উচ্চারণ করেন, হে মানুষ, কখনো হিংসা করো না,প্রতারণা করো না, বিদ্বেষ পোষণ করো না, একে অন্যের মানহানির চেষ্টা করো না, ক্রয়-বিক্রয়ে একজনের দামের উপর অন্যজন দাম করো না। আল্লাহ্র বান্দারা, তোমরা ভাই ভাই হয়ে যাও। মুসলমান মুসলমানের ভাই। না এক ভাই অন্য ভাইকে অত্যাচার করবে, না মিথ্যুক ঠাওরাবে, আর না অপমানিত করবে। এখানেই তাকওয়া(আল্লাহ্র ভয়) রয়েছে। এটা বলার পর তিনি তিন তিনবার নিজের বুকের দিকে ইঙ্গিত করেন। একজন মুসলমানের পাপাচারী ও অনিষ্টকারী হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে, সে আপন মুসলমান ভাইকে লাঞ্ছিত করবে। এক মুসলমানের রক্ত প্রবাহিত রা, সম্মানহানি করা এবং সম্পদ আত্মসাত করা অন্য মুসলামনের জন্য হারাম।[মুসলিম শরীফ: দ্বিতীয় খণ্ড]
প্রাসঙ্গিকভাবে তিনি আরও বলেন, যে কোন মুসলমানের কষ্ট দূর করল, আল্লাহ তায়ালা তার কিয়ামতের কষ্টসমূহ দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোন নিঃস্বব্যক্তিকে সাহায্য করল, আল্লাহ তায়ালা তাকে ইহকালে ও পরকালে সাহায্য করবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষসমূহ গোপন রাখবেন, আল্লাহ সেই বান্দাকে সাহায্য করতে থাকেন, যে কোন বান্দাকে সাহায্য করতে থাকে।যে ব্যক্তি জ্ঞানান্বেষণে বের হয়, আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। যখন কোন জনগোষ্ঠি আল্লাহ্র কোন না কোন ঘরে (মসজিদে) আল্লাহ্র কিতাব (কুরআন) তিলাওয়াত এবং পরস্পর বিদ্যানুশীলনের জন্য সমবেত হয়, আল্লাহ্ তায়ালা আপন রহমত দিয়ে তাদেরকে ঢেকে দেন এবং ফেরেশতারা এসে হাজির হন, আর আল্লাহ্ তায়ালার দরবারেও তাদের সম্পর্কে আলোচনা হয়।(প্রাগুক্ত-মুসলিম শরিফ)
উল্লিখিত ভাষণে বেশ কয়েকটি পয়েণ্ট লক্ষ্য করা যায়-যেমন,একজন মুসলমান আরেকজন মুসলমানের সাহায্য করার বিষয়, পরস্পরের দোষ গোপন রাখার প্রসঙ্গ এবং বিপদ-কষ্ট দূর করলে যে বিরাট পুরস্কার পাওয়া যায় তার স্পষ্ট বয়ান এখানে উদ্ধৃত হয়েছে। আর এটা হচ্ছে, খোদ মহামহিম প্রভু আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ওই ব্যক্তিকে সাহায্য করেন, তার দোষত্রুটি গোপন রাখেন। এ ছাড়া এই ভাষণে এলেম বা জ্ঞান অন্বেষণের বিষয়টিও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যে জ্ঞানান্বেষণের পথে চলে সে মূলত জান্নাতের মসৃণ পথেই চলে। যেখানে কুরআন চর্চা হয়, সেখানে অবশ্যই আল্লাহ্র রহমত নাজিল হয়। সব শেষে পুণ্যকর্মের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে শুধুমাত্র আমলের দ্বারাই উন্নতি ও মর্যাদা লাভ সম্ভব। ইসলামে বংশগত আভিজাত্যের কোন মূল্য নেই, পূর্ব পুরুষকে নিয়ে গর্ব করারও কোন যুক্তি নেই। এটা প্রনিধানযোগ্য-ইসলাম সাধারণ মানুষের নাজাত ও কল্যাণ এবং তাদের পরস্পর ভালবাসার উপর বিরাট গুরুত্ব আরোপ করেছে।
ইসলাম শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, বরঞ্চ প্রতিটি মানুষের অধিকার নির্ধারণ করে দিয়েছে। একারণে কুরআনে বলা হয়েছে, প্রতিটি মানুষের সাথে সদালাপ করবে।রাসূল (সা.) বলছেন আল ইনসানু আখুল ইনসানি-মানুষ মানুষেরই ভাই। [হাকিমের মুসতাদরাক: পৃষ্ঠা ৫৯০] তিরমিজি শরীফে রয়েছে, রাসূল (সা.) আবু যারকে বলেন, যেখানে থাক, আল্লাহ অভিমুখি থেক। অপকারের পর উপকার কর, তাহলে ওই অপকার প্রতিহত হয়ে যাবে। মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার কর। অন্যখানে রাসূল (সা.) বলেন, তুমি সাধারণ মানুষের জন্য তাই পছন্দ কর, যা নিজের জন্য পছন্দ কর, তাহলে তুমি প্রকৃত মুসলমানে রূপান্তরিত হবে।
প্রাণীর প্রতি দরদী রাসূল (সা.) : ইসলামপূর্ব যুগে আরবরা জীবজন্তুর প্রতি নির্দয় আচরণ করত। প্রকৃতপক্ষে জীব জন্তুকে তারা দয়া বা করুণার যোগ্য পাত্র বলে মনেই করত না। যখন কোন ব্যক্তি মারা যেত, তখন তার মালিকানাধীন সমস্ত জীবজন্তুকে তার কবরের উপর বেঁধে রাখা হত এবং ওই অবস্থায়ই অনবরত ক্ষুত পিপাসায় সেগুলো মারা যেত। [সীরাতুন্নবী : ষষ্ঠ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩৪৩] সেইকালে আরবরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে যথেচ্ছভাবে জীবজন্তু যবেহ করত এবং এটাকে নিজেদের জন্য বিরাট গর্বের বিষয় মনে করত। তারা প্রায়ই কোন জীব জন্তুকে বেঁধে তাকে তীরের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করত। কোন কোন সময় তারা জীবিত পশুর কোন না কোন অঙ্গ কেটে নিয়ে তা ভক্ষণ করত, যার কারণে ওই জন্তুটি ছটফট করতে করতে মারা যেত [প্রাগুক্ত: পৃষ্ঠা-৩৪৪] ইসলাম তার রহমের শিক্ষা দ্বারা এই সমস্ত জুলুম প্রতিরোধ করেছে।
রাসূল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি কোন জন্তুকে লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করে হত্যা করবে সে অভিশপ্ত। [তিরমিজি শরিফ] একইভাবে তিনি বলছেন, যে ব্যক্তি জীবন্ত পশুর গোশত খায়, সে মরা খায়। তিনি আরো বলেছেন, যে এরূপ করে, তার উপর আল্লাহ্র অভিশাপ। [বুখারী শরীফ] অন্যত্র উদ্ধৃত হয়েছে রাসূল (সা.) বলেছেন, বিনা প্রয়োজনে পশু জবাই করা একটি জঘন্য অপরাধ। একটি হাদিসে রয়েছে, যে চড়ুই পাখি কিংবা এর চাইতেও ক্ষুদ্র কোন প্রাণীকে অনধিকার জবাই করবে, আল্লাহ্ তায়ালা তাকে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন[মিশকাত: পৃ.৩৫০] নাসায়ীতে বর্ণিত হয়েছে চড়ুই পাখি আল্লাহ্র কাছে এ সম্পর্কে অভিযোগ পেশ করবে।
মহানবী (সা.) একদা বলেন, আল্লাহ্ তায়ালা একজন অতি ইবাদতগুজার রমণীকে শুধু একারণে শাস্তি দিয়েছিলেন যে, সে একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল এবং ওই অবস্থায় বিড়ালটি ক্ষুতপিপাসায় মারা যায়।[বুখারী : পৃষ্ঠা-৪৯৫]
তিনি আরো বলেন, একটি দুশ্চরিত্রা রমণীকে শুধু এজন্য মাফ করে দেওয়া হয়েছিল যে, সে একটি নোংরা কুকুরকে পিপাসার্ত দেখতে পেয়ে তাকে আপন দোপাট্টার [ওড়না] সাহায্যে পানি খাইয়েছিল। [মুসনাদে আহমদ] একদা সফরের সময় জনৈক সাহাবী এমন এক জায়গায় আগুন প্রজ্জ্বলিত করেন, যেখানে অনেক পিঁপড়া ছিল। রাসূল [সা.] তা জানতে পেরে সেখানে যান এবং বলেন, আগুন নিভাও, আগুন নিভাও। [মুসনাদে আহমদ: ১ম খণ্ড, পৃ-৩৯৬]
একদা জনৈক সাহাবী একটি পাখির দুটি বাচ্চা ধরে নিয়ে আসেন। তখন পাখিটি একেবারে অস্থির হয়ে তার মাথার উপর ঘুরপাক খেতে থাকে। হুজুর (সা.) তা জানতে পেরে বলেন, এই পাখিটিকে কে এভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে ?বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে দাও। [আবু দাউদ]
এভাবে মানবতার ধর্ম ইসলামকে উচ্চকিত করা হয়েছে। রাসূলের (সা.) বয়ান থেকে বোঝা যায়, ইসলাম কতটা পবিত্র ও করুণার ধর্ম। দুনিয়ার মানুষের উচিত হবে-ইসলামের শিক্ষা সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান রাখা। ইসলামের মৌল শিক্ষার প্রচারণা বাড়ানোও প্রতিটি মুমিনের দায়িত্ব কর্তব্য। আর এটা না হলে ইসলাম সম্পর্কে চূড়ান্ত অজ্ঞানতার কারণে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার ধর্ম বলে এটা অভিহিত করা হচ্ছে। অন্যান্য ধর্মগুলি সম্পর্কে জানার পাশাপাশি আসুন এ সম্পর্কেও আমরা গভীর জ্ঞানান্বেষণ করি।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও পিএইচডি গবেষক