দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানি বাংলাদেশের সামনে।

নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা সংঘাত ও চরম সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। আর এতে করে দেশের অর্থনীতি, সামাজিক নিরাপত্তা, প্রশাসনিক স্থবিরতা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অবনতি দেখা দেবে এমনই ধারণা বিশেষজ্ঞদের। আর দ্রুত কোনো সমাধান না হলে দেশে স্থায়ী ‘গৃহযুদ্ধ’ ও চরমপন্থীতারও উদ্ভব হতে পারে বলে তাদের আশঙ্কা।

অন্যদিকে বিরোধী জোটের দাবিকে অগ্রাহ্য করে একতরফা ভোটবিহীন নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে সরকার গঠনের সক্ষমতা অর্জন করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ৫ জানুয়ারি ১৪৬ আসনের ভোটগ্রহণ এখন শুধুই আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। তবে একতরফা এই নির্বাচনে গঠিত সরকারের ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কিত আওয়ামী লীগ। আর দলটির শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট- আগামীতে দলটি সরকার গঠন করলে বিভিন্ন প্রতিকূলতার মোকাবেলা করতে হবে তাদের। তাই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর একাদশ নির্বাচন নিয়ে আলোচনার ‘ধুয়া’ তুলছে আওয়ামী লীগ।

এদিকে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহত করতে ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে চায় বিএনপি। আর তাদের এই লক্ষ্য পূরণে ‘কঠোর’ থেকে ‘কঠোরতর’ আন্দোলনে যেতে চায় তারা। তবে বিএনপির এই আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে প্রথম থেকেই। বিশেষ করে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগী সংগঠন ছাত্রশিবিরের সাংঘর্ষিক কর্মসূচির কারণে এই প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত নিজেদের আন্দোলনের ফসল ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত নয় এই জোট।

কার্যত দেশের প্রধান দুই জোট তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন অনিশ্চিত ঠিক তেমনি দেশের ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চিত সাধারণ মানুষ ও সুশীল সমাজ।

অর্থনৈতিক ধস

ধারাবাহিক অবরোধ ও রাজনৈতিক সহিংসতায় দেশের আমদানি-রফতানি, কৃষি, তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে নিত্যপণ্যের সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় মূল্যস্ফীতি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে, যার সংকট সমাধান না হলে চলমান থাকবে। অর্থবছরের মধ্য মেয়াদে এসে অর্থনৈতিক এমন স্থবিরতার ফলে দেশের প্রবৃদ্ধি সাড়ে পাঁচ শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত নেমে যেতে পারে।

এ ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা মির্জা আজিজুল ইসলাম দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টর বিপর্যস্থ হয়ে পড়েছে। কৃষি খাতে বীজ, সার, ডিজেল সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় চলতি মৌসুমে খাদ্যশস্য উৎপাদন কম হবে। একই সঙ্গে উৎপাদিত কৃষি পণ্য সরবরাহ করতে না পারায় দাম পাচ্ছে না কৃষক। এতে চলতি অর্থ বছরের শেষের দিকে দেশের মধ্যে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে এবং সেক্ষেত্রে খাদ্য আমদানির ওপর পুরোটাই নির্ভর করতে হতে পারে।’

আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘শুধুমাত্র কৃষি খাত নয়, পোশাক শিল্পের মতো উৎপাদনশীল খাতগুলোর উৎপাদিত পণ্য পরিবহন ব্যাহত হওয়ায় রফতানিতেও ধস নেমেছে। একই সঙ্গে সময়মতো কাঁচামালের যোগান না পাওয়ায় এ সব খাতের উৎপাদনও অনেক নেমে এসেছে। এতে রফতানি খাত থেকে চলতি এবং আগামী অর্থবছরে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণও কমে যেতে পারে।’

বেসরকারি বিনিয়োগ আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে উল্লেখ করে সাবেক এই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ ভাগই হয় বেসরকারি পর্যায়ে। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিনিয়োগের হার আশঙ্কাজনকভাবে কমতে শুরু করেছে। এতে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি অশনিসংকেত অপেক্ষা করছে। দেশের ক্রমবর্ধমান প্রবৃদ্ধি কমে সাড়ে পাঁচ শতাংশ থেকে পাঁচ শতাংশে নেমে যেতে পারে। একই সঙ্গে কৃষিপণ্য উৎপাদন ও খাদ্য সরবরাহ ব্যহত হওয়ায় মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকবে।’

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অবনতি

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সকল উদ্বেগকে উপেক্ষা করে একতরফাভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনড় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে রাজনৈতিক ছাড় দেওয়ার ব্যাপারেও নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করেনি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। আর এতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের উদ্যোগ ছিলো চোখে পড়ার মতো। বিরোধী দলবিহীন ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিশ্চিত জেনে একে একে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ), কমনওয়েলথ ও যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের বন্ধু হিসেবে পরিচিত রাশিয়াও পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ খ্যাত ভারত ব্যতীত কেউই এই নির্বাচনকে সমর্থন দিচ্ছে না। আর সরকারের এমন অনড় সিদ্ধান্তের ফলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের চিড় ধরতে পারে বলে আশঙ্কা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বেপারি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘দৃশ্যত ভারত ব্যতীত অন্য কোনো রাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের বন্ধু নয়। আওয়ামী লীগের গোয়ার্তুমি সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশ তার বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক হারাচ্ছে। কিন্তু ভারতের মতো বন্ধু যার পাশে থাকে তার আর কোনো শত্রুর প্রয়োজন হয় না।’

নুরুল আমিন বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন নিয়ে দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সংঘাতময় পরিস্থিতি নিয়ে ইউএনসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বার বার তাদের উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেছেন। সবার উদ্বেগকে অগ্রাহ্য করে সরকার শুধু ভারতে ভরসায় এই নির্বাচন করছে। আওয়ামী লীগ যদি তার অবস্থানের পরিবর্তন না করে তাহলে দেশে একটি স্থায়ী সংঘাতময় অবস্থার সৃষ্টি হবে। এতে মানুষের মৌলিক অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক ধস, বিদেশি কূটনীতিকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। আর তখন জাতিসংঘ থেকে যেকোনো ধরনের অবরোধসহ তাদের সরাসরি হস্তক্ষেপও আসতে পারে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সফর শেষে জাতিসংঘের বিশেষ দূত তারানকোও নাকি তার রিপোর্টে এমনই আভাস দিয়েছেন।'

আইনশৃঙ্খলার অবনতি

দেশের প্রধান দুই দলের মধ্যে সমঝোতা না হলে দেশের চলমান সংঘাতময় পরিস্থিতি এবং সহিংসতা স্থায়ী রূপ নিতে পারে বলে মনে করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকগণ। তাদের মতে, চলমান সহিংসতা রোধ করতে ইতোমধ্যেই সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অন্যদিকে বিরোধী দলও তাদের কর্মসূচিগুলোতে সংঘর্ষ পরিহার করতে পারছে না। ফলে কোনো সমাধান না হলে বিচারবহির্ভূত ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বেড়ে যেতে পারে। একই সঙ্গে লুকিয়ে থাকা চরমপন্থী সংগঠনগুলোকেও উভয় পক্ষ ব্যবহার করতে পারে। এতে দেশের জননিরাপত্তা বিঙ্ঘিত হওয়াসহ আইন-শৃঙ্খলার চরমভাবে অবনতি ঘটতে পারে।

এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আমীন চৌধুরী দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নির্বাচন সম্পন্ন করতে যেমন অনড় তেমনি বিরোধী দলও সেই নির্বাচনকে প্রতিহত করতে সর্বশক্তি প্রয়োগে পিছপা হবে না। বিশেষ করে ১৮ দলের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলাম ও শিবিরের তাণ্ডবে কার্যত ঢাকা ছাড়া দেশের অন্যান্য জেলা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এখন যৌথবাহিনী ও সেনাবাহিনী মোতায়েনের মাধ্যমে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে তাও স্থায়ী নয়। আর সরকার যদি নির্বাচন করেই ফেলে তাহলে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষায় জামায়াত-শিবির আরো মরিয়া হয়ে উঠবে।’

রুহুল আমীন বলেন, ‘একদিকে নতুন সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকতে সহিংসতা দমনে সকল প্রকার শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করবে। আর এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়াও দলীয় ক্যাডারও যুক্ত হবে। এতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে গুপ্তহত্যার মতো চরমপন্থিতার পথ বেছে নেবে বিরোধী শক্তিগুলো। আর এক্ষেত্রে দেশের উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে চরমপন্থি সংগঠনগুলোকেও ব্যবহার করতে পিছপা হবে না কোনো পক্ষ। ফলে দেশের মধ্যে একটি অনিবার্য যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে।’

(দ্য রিপোর্ট/ এইচআর/ এসবি/ নূরুল/ডিসেম্বর ২৭, ২০১৩)