‘মার্চ’শব্দটি ইংরেজি বর্ষপঞ্জিকার তৃতীয় মাস হিসেবে সমধিক পরিচিত। এর বাইরেও শব্দটির একাধিক অর্থ রয়েছে। যেমন-সৈনিকদের মতো কুচাকাওয়াজ করে চলা, সীমান্ত এলাকা বা বিশেষ বিরোধপূর্ণ এলাকা।

বাংলা ঋতুর ফাল্গুনে মার্চ মাসের আগমন। কিন্তু ‘মার্চ’শব্দটি যেসব ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সঙ্গে সম্পৃক্ত তাতে ফাল্গুনের রোমান্টিক সময়ের সঙ্গে যায় না বললেই চলে।

শব্দটি ঐতিহাসিক হয়ে উঠেছে মাও সেতুঙ (মাউ জেডঙ নামের বর্তমান উচ্চারণ) এর নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়া লংমার্চের মাধ্যমে। এরপর নানান দেশে লংমার্চের প্রভাব পড়েছে। এখনো অব্যাহত আছে। কালের পরিক্রমায় সংগঠিত হওয়া অনেক লংমার্চ ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে, নিচ্ছে। আবার লংমার্চের নাম করে অনেক সংকীর্ণ স্বার্থের বিষয়েও এ কর্মসূচি ব্যবহার করা হচ্ছে। ইতিহাস অবশ্য তার নিজের থলিতে সফলদেরকেই ঠাঁই দেয়।

মাও সে তুঙ-এর লংমার্চ

চীনের কিয়াংশি প্রদেশে ছিল লালফৌজের সবচেয়ে বড় ও মূল ঘাঁটি। ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের এই প্রদেশটিতেই প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তারা। এসময় পার্টির অভ্যন্তরে অবস্থিত হটকারীদের আত্মবিধ্বংসী কার্যক্রমের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী চিয়াং কাইশেকের সরকারি বাহিনী লালফৌজের ওপর ভয়াবহ চাপ তৈরি করে। মাও সেতুঙ নিজেদের রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৩৪ সালের অক্টোবর মাসে কিয়াংসি ত্যাগ করেন। সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বহু সংঘর্ষ মোকাবেলা করে ১২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার অর্থাৎ প্রায় আট হাজার মাইল অতিক্রম করে ১৯৩৫ সালের অক্টোবর মাসে উত্তর-পশ্চিমের সেনশি এলাকায় এসে পৌঁছে।

যুদ্ধ ও বিপদ সঙ্কুল এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমার ইতিহাসে ‘লংমার্চ’নামে বিখ্যাত হয়েছে।

মাও সেতুঙ-এর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বাধীন লালফৌজের অংশ এক বছরের মধ্যে উল্লেখিত পথ পাড়ি দিতে পেরেছিল। তার বাহিনীর হুনান, হুপে ইত্যাদি এলাকা থেকে রওনা হওয়া অন্যান্য বাহিনীর অংশ সেনশি এসে পৌঁছায় ১৯৩৬ সালের অক্টোবর মাসে। এই হিসেবে দুই বছরকে লংমার্চের সময় হিসেবে ধরা হয়।

লংমার্চ লালফৌজকে শুধু ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেনি, একইসঙ্গে তাদের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বিজয়ের পর লালফৌজের শক্তি ও আত্মপ্রত্যয় বৃদ্ধি করেছে। যদি এর জন্য তাদেরকেও প্রচুর পরিমাণে রক্ত ব্যয় করতে হয়েছে। এর বিপরীতে বিরোধী শক্তির মনোবল ব্যাপকভাবে ভেঙ্গে দিতে সমর্থ হয়। এই লংমার্চে লালফৌজের অন্যতম অর্জন হলো, তাদের দলের সুবিধাবাদী অংশকে চিহ্নিত করতে পারা এবং নিবেদিতপ্রাণ অংশকে পরীক্ষার মাধ্যমে পাওয়া। এতে করে বিশ্বের বুকে স্থান করে নেওয়া লালফৌজ ত্যাগ-তিতিক্ষা ও শৃঙ্খলার এক আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করে।

মাওলানা ভাসানীর লংমার্চ

‘মরণ ফাঁদ ফারাক্কা বাঁধ’ করার প্রতিবাদে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ফারাক্কা বাঁধ অভিমুখে হাজার হাজার জনতার লংমার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম এবং সফলতম লংমার্চ হিসেবে এখনো পর্যন্ত প্রশ্নাতীত।

ভারতীয় পানি আগ্রাসনের প্রতিবাদে এই দিন বাংলার সর্বস্তরের মানুষের বজ্রকণ্ঠ গর্জে উঠেছিল ভাসানীর আহ্বানে। কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল ভারতের শাসক মহলে। লং মার্চের রেশ উপমহাদেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে তার আওয়াজ।

আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ভারত একতরফাভাবে গঙ্গায় অবৈধভাবে বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য আজ মরণ ফাঁদে পরিণত করেছে। ১৯৭২-৭৫ সালে তৎকালীন সরকার ভারতকে এই বাঁধ চালুর অনুমতি দেয়। এরপর থেকে পদ্মা নদীর বাংলাদেশ অংশে শুরু হয় মরুর হাহাকার। এই বাঁধের আড়ালে ভারত অভ্যন্তরীণভাবে আরো প্রায় তিন’শ বাঁধ দিয়েছে। ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চের সূচনা হয় রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দান থেকে। শেষ হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে। ওই দিন রাজশাহী থেকে শুরু হয় জনতার পদযাত্রা। হাতে ব্যানার আর ফেস্টুন নিয়ে মানুষে মানুষে ভরে যায় রাজশাহীর রাজপথ। ভারত বিরোধী নানা শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয় জনপদ।

হাজার হাজার মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবে যোগ দেয় এই লংমার্চে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণে ভারতের দ্বিমুখি উদ্দেশ্য ছিল এমনটাই অভিজ্ঞ মহল বলে আসছেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির মধ্যদিয়ে নদীপ্রবাহও বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের পটভূমিতে অরুণাচল অঞ্চল ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে কৌশলগতভাবে আসাম-ত্রিপুরার নিরাপত্তা হুমকির মুখে পতিত হয়।

গঙ্গার ওপর দিয়ে দ্রুত যুদ্ধসরঞ্জাম পূর্বাঞ্চলের নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি বাঁধ নির্মাণ প্রয়োজন হয় ভারতের। সেই পরিকল্পনার আলোকেই বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মিত হয়। ১৯৭৪ সালে ভারত পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার কথা বলে বাংলাদেশের সমর্থন নিলেও অদ্যাবধি তা অব্যাহত আছে।

১৯৭৬ সালে মাওলানা ভাসানীর ঐতিহাসিক প্রতিবাদ লংমার্চ পদযাত্রা গোটা জাতির চেতনাকে শাণিত করে। তৎকালীন সরকার যখন ভারতের সঙ্গে ফারাক্কা সমস্যা নিয়ে দর কষাকষি করছিল, তখন মওলানা ভাসানীর এই পদযাত্রা সরকারের দর কষাকষিতে প্রবল শক্তি সঞ্চয় করে।

মার্চ অন রোম

‘মার্চ অন রোম’বেনিটো মুসোলিনির ক্ষমতায় আরোহণের নাটকীয় উপাখ্যানের অংশ। মুসোলিনির হুমখির মুখে রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমানুয়েল নতি স্বীকার করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন। সরকার গঠন করার জন্য মুসোলিনিকে আহবান জানান।

ফ্যাসিবাদীরা ইতালির কয়েকটি শহরের কতৃত্ব গ্রহণ করার পর দেশজুড়ে গৃহযুদ্ধ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ১৯২২ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহের দিকে মুসোলিনি রাজধানীতে প্রবেশের সবগুলো পথে তার সমর্থকদের মোতায়েন করেন এবং ফ্যাসিবাদী সরকার গঠনের দাবি করেন। এভাবে অতিনাটকীয়তার কারণে একে বলা হয় ‘রোম অভিযাত্রা’।

মুসোলিনির হুমখির মুখে রাজা তৃতীয় ভিক্টর ইমানুয়েল নতি স্বীকার করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন। সরকার গঠন করার জন্য মুসোলিনিকে আহবান জানান ।

খালেদা জিয়ার- রোডমার্চ, মার্চ ফর ডেমোক্রেসি

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টন থেকে সিলেট অভিমুখে রোড মার্চের নেতৃত্ব দেন বিরোধী দলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

রাজধানীর নয়া পল্টনে অবস্থিত বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বিভাগীয় শহর সিলেট অভিমুখে যাত্রা শুরু করে খালেদা জিয়ার রোড মার্চ। পথে প্রায় দশটি স্থানে পথসভা করে সিলেটে পৌঁছার পর শেষ হয় রোড মার্চ। এতে তিন হাজারের মতো গাড়ি অংশ নিয়েছিল বলে দলীয়ভাবে জানানো হয়।

২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর একই দাবিতে আবারো নতুন ধরনের কর্মসূচি দেন বিএনপি প্রধান। নাম হয় ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ বাংলায় বলা হয় ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’। অবশ্য এই নামের সঙ্গে ১৯২২ সালে মুসোলিনির ‘রোম অভিযাত্রা’ শিরোনামটির ‘ভাষাগত’ সামান্য মিল পাওয়া যায়।

এরশাদের লংমার্চ

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ২০১২ সালের ১৭ ও ১৮ জানুয়ারি তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে লং মার্চ কর্মসূচি পালন করে। এর আগে ২০১১ সালের টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে লংমার্চ করে জাতীয় পার্টি।

ক্রমক্ষয়িষ্ণু জাতীয় পার্টির হঠাৎ এমন কর্মসূচিতে দেশবাসী কিছুটা অবাক হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যাদের ভারতের সঙ্গে সখ্য আছে বলে গুঞ্জন রয়েছে তাদের অন্যতম হচ্ছেন সাবেক এই স্বৈরশাসক। এসব কর্মসূচির কিছুদিন আগে তিনি ভারত সফর করে আসায় তার দিকে সন্দেহের নজর ছিল সবারই।

সুন্দরবন বাঁচাতে লংমার্চ

সুন্দরবন রক্ষায় রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল এবং জাতীয় কমিটি ঘোষিত সাত দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ২৪ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৩ পর্যন্ত পালিত হয় সুন্দরবন বাঁচা কর্মসূচি। তেল-গ্যাস বিদ্যুৎ-বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা জাতীয় কমিটি দীর্ঘদিনের আন্দোলনে বাংলাদেশের জাতীয় সম্পদের উপর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করছে। তারই অংশ হিসেবে লং মার্চের উদ্যোগ নেয় জাতীয় কমিটি। এর নেতৃত্বে ছিলেন কমিটির আহ্বায়ক শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

সুন্দরবনের গ্যাস ব্লক বিদেশিদের কাছে ইজারাদান, ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত কয়লা খনি করার অপচেষ্টাসহ সরকারের বিভিন্ন গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিষয় উল্লেখ করে এই লংমার্চের আয়োজন করেন তারা।

দক্ষিণ এশিয়ার একটি অনন্য বন সুন্দরবন। এ অঞ্চলের জীববৈচিত্র্যের ধারক ও মহাপ্রাণ উল্লেখ করে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বলা হয়, সুন্দরবন কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার জন্য জরুরি একটি প্রাকৃতিক সম্পদ। বিশেষ করে ভরতের প্রাণ প্রকৃতি এবং মানুষকেও এই লংমার্চ সাহায্য করছে। কিন্তু ভারত বাংলাদেশ উভয়ের লুটেরারা মুনাফার লোভে সুন্দরবনকে ধ্বংস করতে চায়। লংমার্চের মাধ্যমে এই দুই দেশের লুটেরাদের প্রতিহত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয় লং মার্চে।

হেফাজতে ইসলামের লংমার্চ

হেফাজতে ইসলামের ভাষ্যে, ইসলামী রীতি-নীতি অনুযায়ী রচিত ১৩ দফা দাবি বাস্তবায়ন নিয়ে চলতি বছরের ৬ এপ্রিল লংমার্চ কর্মসূচি পালন করে হেফাজতে ইসলাম। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা অভিমুখী এই লংমার্চ সরকার সমর্থকদের ডাকা হরতাল এবং সরকারের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে সফলতার মুখ দেখেনি। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সেক্টরস কমান্ডারস ফোরাম, গণজাগরণ মঞ্চসহ বেশ কিছু সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন ২৪ ঘণ্টার হরতাল ডাকে। ফলে এদিন সুবিধামতো কর্মসূচি পালন করতে না পারায় পরবর্তী মাসে (৫ মে) নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে। যেদিন ঢাকার পরিস্থিতি ছিল রীতিমতো রণক্ষেত্র।

লং মার্চ আছে নাটকেও ...

লং মার্চ নামে বিনোদনমূলক নাটকও প্রচারিত হয়েছে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে। চলতি সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা মোশারফ করিম, তিশা, ডা. এজাজ, আখম হাসান প্রমুখ এই নাটকে অভিনয় করেন। নাটকের মূল বক্তব্য, অযোগ্য শিল্পী ও হাতুড়ে ডাক্তারকে প্রতিভা খোঁজার নামে হিরো বানানো হয়।

তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট ও রাজনীতি কোষ

(দ্য রিপোর্ট/বিকে/এইচএসএম/ডিসেম্বর ২৯, ২০১৩)