সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : ‘চারণ সাংবাদিক’ খ্যাত মোনাজাতউদ্দিন ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। মফঃস্বল সাংবাদিকতার এই পথিকৃৎ ছোটগল্প ও নাটক রচনা, আলোকচিত্র, প্রচ্ছদ ও অলংকরণ প্রভৃতি ক্ষেত্রেও কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন।
মোনাজাতউদ্দিন ১৯৪৫ সালের ১৮ জুন রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার মরনিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা আলিমউদ্দিন আহমদ ও মা মতিজাননেছা। আলিমউদ্দিন আহমদ ‘আম্বিয়া চরিত’ নামে একটি বই রচনা করেন। ‘আধুনিক যোদ্ধা’ নামে তার আরেকটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি রয়েছে।
মোনাজাতউদ্দিনের পড়াশোনা শুরু গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। রাজশাহী বোর্ডের অধীনে রংপুর কৈলাসরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। রংপুর কারমাইকেল কলেজে থেকে মানবিক শাখায় এইচএসসি পাশ করেন।
কারমাইকেল কলেজে বিএ পড়াকালে বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের দায়-দায়িত্ব নিতে হয় তাকে। লেখাপড়া ছেড়ে নিশাতগঞ্জ সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়ে চাকরি নেন। এরপর পিডিবি অফিসে একাউন্ট্যান্ট ও রংপুর পাবলিক লাইব্রেরির ক্যাটালগার হিসেবে কাজ করেন। এ সব কাজের মাঝেই প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাশ করেন ।
ছাত্রাবস্থায় বগুড়া বুলেটিন’ পত্রিকার মাধ্যমে মোনাজাতউদ্দিনের সাংবাদিকতার শুরু। ১৯৬২ সালে তিনি ঢাকার ‘দৈনিক আওয়াজ’ পত্রিকার স্থানীয় সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৬ সালে ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। এর আগে কিছুদিন ‘দৈনিক পূর্বদেশ’ পত্রিকায়ও কাজ করেন। ১৯৭২ সালের মার্চে স্থানীয় সংবাদের ভিত্তিতে প্রকাশ করেন ‘দৈনিক রংপুর’। মোনাজাতউদ্দিন ছিলেন পত্রিকাটির সম্পাদক ও প্রকাশক। লগ্নিকারক অসৎ ব্যবসায়ী হওয়ায় তিনি পত্রিকাটি ছেড়ে আসেন। তখন ঢাকায় ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকাও বন্ধ। বাধ্য হয়ে একটি কীটনাশক কোম্পানিতে চাকরি নেন।
১৯৭৬ সাল থেকে টানা ২০ বছর ‘দৈনিক সংবাদ’-এ কাজ করেন। ১৯৯৫ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি দৈনিক জনকণ্ঠে সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি সেখানেই কর্মরত ছিলেন।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি সাংস্কৃতিক ও সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করেন। গ্রামীণ মানুষের কুসংস্কার দূর করতে তরুণদের সংগঠিত করে তোলেন। তাদের নাটক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি গান ও নাটকও রচনা করতেন। রংপুর বেতারে নিয়মিত কাজ করতেন। তার একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই অনেক বই ও ছোট কাগজের প্রচ্ছদ করেছেন। একজন দক্ষ ফটোগ্রাফারও ছিলেন তিনি ।
তার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে- পথ থেকে পথে, সংবাদ নেপথ্য, কানসোনার মুখ, পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ, নিজস্ব রিপোর্ট, ছোট ছোট গল্প, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন: গ্রামীণ পর্যায় থেকে, চিলমারীর একযুগ, শাহ আলম ও মজিবরের কাহিনী, লক্ষীটারী, কাগজের মানুষেরা ও মোনাজাতউদ্দিন রচনাসমগ্র (দুই খণ্ড)। মাসিক মোহাম্মদী, দৈনিক আজাদ, সওগাত ও অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় তার বেশ কয়েকটি গল্প ও ছড়া প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত একমাত্র নাটকের নাম ‘রাজা কাহিনী’।
কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি অনেক পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। উল্লেখযোগ্য পুরষ্কার ও সম্মাননার মধ্যে রয়েছে- সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী স্মৃতি পদক (১৯৮৪), ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব বগুড়ার সম্মাননা সার্টিফিকেট (১৯৮৫), দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত ‘মানুষ ও সমাজ’ প্রতিবেদনের জন্য ফিলিপস্ পুরস্কার (বাংলা ১৩৯৩ সাল), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স পুরস্কার (১৯৮৭), রংপুর পদাতিক গোষ্ঠীর গুণীজন সংবর্ধনা (১৯৮৮), অশোকা ফেলোশিপ (১৯৯৫) এবং ১৯৯৭ সালে অর্জন করেন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পদক একুশে পদক।
নাসিমা আক্তার ইতিকে ১৯৭০ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিয়ে করেন। এই দম্পতি দুই মেয়ে ও এক ছেলে।
১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর ফুলছড়ি থানাধীন যমুনা নদীতে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে দু’টি নৌকাডুবির তথ্যানুসন্ধান করতেই অসুস্থ শরীর নিয়ে যাত্রা শুরু করেন গাইবান্ধায়। যাবার পথে ‘শেরেবাংলা’ নামের ফেরির ছাদ থেকে হঠাৎ করেই পানিতে পড়ে যান। পানিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ৩০ ডিসেম্বর তাকে রংপুর শহরের মুন্সীপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়।
(দ্য রিপোর্ট/ডব্লিউএস/ এমডি/ডিসেম্বর ২৯, ২০১৩)