রাজু হামিদ, দ্য রিপোর্ট : আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়লেও টেকসই সমাধান আসেনি। বাড়েনি সুবিধাভোগীর সংখ্যাও। বেড়েছে ভর্তুকি ও বিদ্যুতের দাম।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিইউবি) তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছরে উৎপাদন বেড়েছে ১০৬ শতাংশ। অন্যদিকে গ্রাহক বেড়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ। এ সময়ে নয় হাজার ৯০৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৭০টি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে সরকার। এরমধ্যে তিন হাজার ৪৩৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৭টি কেন্দ্র উৎপাদন শুরু করেছে। যার মাধ্যমে সরকার ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছে।

‘কৌশলী’ বিদ্যুৎ বিভাগ এই টার্গেট পূরণে আগেভাগে ৭৪৫ মেগাওয়াটের ভাড়াভিত্তিক নয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ায়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে স্থায়ী বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাজ শেষ না হওয়ায় এমন কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়।

বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্র মতে, বর্তমানে ১৮ থেকে ১৪৯ মেগাওয়াটের ২১টি কেন্দ্র নির্মাণাধীন। যেগুলোর নির্মাণ অগ্রগতি নেই বললেই চলে। আরও ৫ হাজার ২১১ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৬টি বড় কেন্দ্রের (প্রতিটি ২৫০ মেগাওয়াটের উপরে) কার্যাদেশ দেওয়া হলেও একমাত্র সরকারি হরিপুর ৩৬০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি উৎপাদনে এসেছে। এর বাইরে বেসরকারি খাতের মেঘনাঘাট ৩৩৫ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র চালুর অপেক্ষায়।

সরকারি প্রকল্পের ধীরগতিতে বেসরকারি খাতের উৎপাদন বেড়েছে অনেকগুন। ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ছিল ৬০ শতাংশের বেশি। এখন বেসরকারি কোম্পানিগুলো ৬০ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। যা ২০১৬ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশে পৌঁছাবে।

সাবেক বিদ্যুৎ সচিব আ ন হ আক্তার হোসেন বলেন, সরকার নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে ব্যয়বহুল ভাড়াভিত্তিক প্রকল্প বসিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়েছে। ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির কথা বললেও অধিকাংশই রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্র। যা বাদ দিলে প্রকৃত উৎপাদন বেড়েছে সর্বোচ্চ এক হাজার মেগাওয়াট। যার জন্য ভর্তুকি দিতে হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা।

সূত্র মতে, পাঁচ বছরে বিদ্যুৎখাতে ভর্তুকি বেড়েছে আগের চেয়ে ছয় গুণ বেশি। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত।

বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের মেয়াদে পাইকারি পর্যায়ে ৬ বারে ৯৮ দশমিক ৩১ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে ৫ বারে দাম বেড়েছে ৪৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সর্বশেষ বাড়ানো হয় গত সেপ্টেম্বরে। সেবার বিদ্যুতের পাইকারি পর্যায়ে গড়ে ১৬ দশমিক ৯২ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ১৫ শতাংশ দাম বাড়ে। এ সময়ে উৎপাদন ব্যয় প্রায় তিন গুণ বেড়ে গড়ে ৬ টাকা হয়েছে।

সরকারের পরিকল্পনায় ছিলো বিদ্যুৎখাতে বহুমুখী জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো। মেয়াদের শেষ পর‌্যায়ে এসেও তা নিশ্চিত করতে পারেনি। এখনো উৎপাদিত বিদ্যুতের ৬৪ দশমিক ৫০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস, ২৫ দশমিক ৯০ শতাংশ তরল জ্বালানি, দুই দশমিক ৪৫ শতাংশ কয়লা থেকে উৎপাদিত হয়।

বিদ্যুৎ বিভাগের পরিকল্পনায় ১০ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার ১৩টি কয়লাভিত্তিককেন্দ্র নির্মাণের কথা থাকলেও একটিরও কাজ শুরু হয়নি। অধিকাংশ উদ্যোক্তা অর্থায়ন নিশ্চিত করতে পারেনি।

বাগেরহাটের রামপালে বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে কয়লাভিত্তিক ১৩২০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধীতা করছে পরিবেশবাদী সংগঠণগুলো।

কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করা হলেও বিতরণ ব্যবস্থার কারণে এর সুফল ঘরে তুলতে পারছে না সরকার।

বিইউবি সূত্র জানায়, দেশে বিতরণ লাইন রয়েছে দুই লাখ ৬৬ হাজার ৪৬০ কিলোমিটার। যা যথেষ্ট নয়। তার ওপর বিদ্যমান লাইনের মধ্যে অন্তত ৩০ শতাংশ জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে।

এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরী বলেন, ‘সরকারের মূল পরিকল্পনায় ছিল বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ানো। আমরা সেখানে ‘গোল্ডেন এ’ মার্কস পেয়েছি। দ্বিতীয় ধাপে আমরা উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালনের কাজগুলো শেষ করার পরিকল্পনা নিয়েছি। এ কারণেই নতুন গ্রাহকের সংখ্যা খুব বেশি বাড়েনি।’

বিএনপির মতো এ সরকারের আমলেও অপরিকল্পিতভাবে কেনা হয়েছে খাম্বা। ১৮ লাখ নতুন গ্রাহককে বিদ্যুৎ দিতে ৪৫ হাজার কিলোমিটার লাইন স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এজন্য বিভিন্ন ধরনের নয় লাখ খুটি কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

সরকারের ৫ বছরে বিদ্যুৎখাতের অবস্থা মূল্যায়ন করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারে প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. ম তামিম বলেন, বর্তমান সরকার বিদ্যুৎ ঘাটতির সাময়িক সমাধান দিলেও সাশ্রয়ী ও বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিদ্যুতের প্রধান সমস্যা প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের বিকল্প উৎস্ দিতে পারেনি।

(দ্য রিপোর্ট/আরএইচ/এসবি/ডিসেম্বর ২৯, ২০১৩)