বিরোধী জোটের ডাকা ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি ‘প্রতিহত’ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ‘সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে সরকার। আর আইনজীবী ও সাংবাদিক সমাজের মতো পেশাজীবীদের উপর পুলিশ ও সরকারি দলের হামলাকে আইনের শাসনের পক্ষপাত বলে মনে করছেন অনেকে।

রবিবার বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে পূর্বঘোষিত ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচির সমাবেশ হওয়ার কথা থাকলেও পুলিশি বাধার কারণে সমাবেশস্থলে হাজির হতে পারেননি জোটনেত্রী খালেদা জিয়া। আর নেত্রীকে তার বাড়ি থেকে বের হতে না দেওয়ার আশঙ্কা থেকেই নয়াপল্টনে দেখা যায়নি বিরোধী জোটের তৃণমূল নেতাকর্মীদের। বিচ্ছিন্ন দু-একটা ঘটনা ছাড়া ঢাকা শহরে কোথাও দেখা যায়নি তাদের। এমনকি জোটের শীর্ষ নেতাদের অনেকেই ছিলেন বরাবরের মতো আত্মগোপনে।

তবে বিএনপি বা জোটের অন্য কোনো শরিক দলের নেতাকর্মীরা নয়াপল্টনমুখী না হলেও সাংবাদিক সংগঠন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) বিএনপিপন্থি অংশদ্বয় পুলিশের বাধা ভেঙে নয়াপল্টনে যাওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশের বাধা ভেঙে বের হতে না পেরে প্রেস ক্লাব চত্বরে সমাবেশ করে তারা। এ সময় প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে যাওয়া ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার নেতৃত্বে একটি মিছিল থেকে সাংবাদিক সমাবেশের উপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়। তারা অভিযোগ করে, বিএনপিপন্থি সাংবাদিকদের সমাবেশ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটূক্তি করা হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের মিছিল থেকে সাংবাদিকদের উপর এমন হামলায় পুলিশকে নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায় বলে অভিযোগ ওঠে। সাংবাদিকদের ওই অংশের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের এই মিছিলটি বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কেন্দ্রিক হলেও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘ছত্রছায়া’য় পরিকল্পিতভাবে প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে যায়।

একই ধরনের ঘটনা ঘটে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায়। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের ব্যানারে আইনজীবীদের একাংশ মিছিল করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গেট দিয়ে বের হতে চাইলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। মূল ফটক আটকে দিয়ে পুলিশ তাদের হাইকোর্ট চত্বর থেকে বের হওয়ার সুযোগ দেয়নি। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের আরেকটি মিছিল থেকে আইনজীবীদের উপর হামলা করা হয়। এ সময় পুলিশ প্রধান ফটক খুলে দিয়ে আইনজীবীদের উপর হামলা করার সুযোগ করে দেয় বলে অভিযোগ ওঠে। সরকারদলীয় কর্মীদের হকিস্টিক ও লাঠির আঘাতে নারী আইনজীবীসহ বেশ কয়েকজন আইনজীবী আহত হন। এ সময় পুলিশ আইনজীবীদের উপর সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। পরবর্তীকালে আইনজীবীদের বিক্ষোভ দমন করতে পুলিশের দুটি জল কামান থেকে অনবরত রঙিন পানি নিক্ষেপ করা হয়।

দেশের বিশিষ্টজনদের মতে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম প্রেস ক্লাব ও সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে প্রবেশ করে হামলা করা হলো। এদিকে এই ঘটনার দায় এড়িয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করে বলেন, ‘বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের মিছিলে কোনো আইনজীবী ছিলে না। জামায়াত-শিবিরের ক্যাডাররা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পুলিশের উপর হামলা চালায়।’

এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশ নয়, হাইকোর্টের ইতিহাসে এই প্রথম বহিরাগত সন্ত্রাসীরা আইনজীবীদের উপর হামলা করল। আর আইনের রক্ষক হিসেবে পুলিশ তাদের মদদ দিয়েছে। এটা আইনের শাসন হতে পারে না। এতে বোঝা যায় দেশে সুশাসন নেই।’

একই প্রসঙ্গে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নির্বাহী পরিচালক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘নাশকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে এই দোহায় দিয়ে পুলিশ বিরোধী দলের কর্মসূচিকে প্রতিহত করেছে। এটা পুলিশের দায়িত্ব বুঝলাম, কিন্তু সরকার দলের সমর্থকদের মদদ দিয়ে তারা কিভাবে বিরোধীদলীয় পেশাজীবীদের উপর হামলা করালো। আজ যদি বিরোধী দলের সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে সরকারি দলেরও মিছিল সমাবেশ নিষিদ্ধ হওয়া উচিত ছিলো। এটা স্পষ্ট সুশাসনের অভাব।’

তবে পুলিশের পক্ষ থেকে কাউকে মদদ দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি বলে দাবি করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘আমরা রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে বিরোধী দলকে বাধা দিয়েছি। কিন্তু অন্য কোনো পক্ষকে প্রশ্রয় দিয়ে হামলা করানোর মতো কিছু করিনি। সুপ্রিম কোর্ট ও প্রেস ক্লাবে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে তা তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

(দ্য রিপোর্ট/এইচআর/এইচএসএম/সাদিক/ডিসেম্বর ২৯, ২০১৩)