বিরোধী জোটের ডাকা ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মনে করছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। তবে পুলিশ বলছে সংবিধানের বাইরে কোনো কাজ করছে না তারা।

গত রবিবার ও সোমবার (পরিবর্তিত সময়) প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানীর সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা কার্যত অচল করে দেয় সরকার। দেশের ৬৩টি জেলা থেকে ঢাকামুখী সব গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমনকি সরকারি গণপরিবহন রেল ও বিআরটিসির বাসও এর থেকে বাদ পড়েনি। এ ছাড়া জনসাধারণের অবাধ চলাফেরায়ও বিঘ্ন ঘটানোর অভিযোগ উঠেছে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে।

পাশাপাশি ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ প্রতিহত করতে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের অবাধে মিছিল, সমাবেশ ও বিক্ষোভ করতে কোনো প্রকার বাধা দেওয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের বাঁশের লাঠি, হকিস্টিকসহ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েও মিছিল করতে দেখা গেছে।

রবিবার সুপ্রিমকোর্টে বিএনপিপন্থী আইনজীবী ও প্রেসক্লাবে দলের সমর্থক সাংবাদিকদের ওপর সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের হামলার ঘটনাও ঘটেছে।

বিরোধী দলের ঘোষিত ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট ঘটনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজ্ঞ ও সুশীল সমাজ। তারা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন কর্মকাণ্ড সংবিধানের ২৭, ৩৬ ও ৩৭ অনুচ্ছেদের স্পষ্ট লংঘন।

সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’

অনুচ্ছেদ ৩৬-এ বলা হয়েছে, ‘জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’

অুনচ্ছেদ ৩৭-এ বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’

এ সব বিষয়ে কথা বলা হলে প্রবীণ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের নাগরিকের অবাধ চলাচলের অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা দেখছি শুধু সন্দেহভাজনরাই নয়, সব শ্রেণী-পেশার মানুষের চলাচলে কিভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে।’

রফিক-উল হক বলেন, ‘অনুচ্ছেদ ৩৭-এ বলা হয়েছে, নিরস্ত্র অবস্থায় ও শান্তিপূর্ণভাবে যে কেউ সভা-সমাবেশ করার এবং যোগদানের অধিকার রাখে। কিন্তু বিএনপির কর্মসূচিতে যোগদান করতে পারে এমন আশঙ্কায় ঢাকায় কোনো মানুষকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। আর যদি পুলিশ জানতে পারে কেউ বিএনপির এই কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য যাচ্ছেন তাহলে তো তাকে শুধু বাধা নয়, আটকও করা হচ্ছে।’

সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করে রফিক-উল হক বলেন, ‘রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমান অধিকার এই অনুচ্ছেদে নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু সরকার বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশে বাধা দিলেও সরকারদলীয়দের মিছিল, সভা-সমাবেশে কোনো বাধা দিচ্ছে না। যা আইনের শাসনের পুরোপুরি বিরোধী ও সংবিধানের স্পষ্ট লংঘন।’

ব্যারিস্টার রফিক বলেন, ‘রাজনৈতিক কর্মসূচিকে মোকাবেলা করতে হবে আরেকটি রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে। এখানে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু বর্তমানে সেটা এমনভাবে করা হচ্ছে, তাতে সংবিধানও মানা হচ্ছে না।’

রফিক-উল হক বলেন, ‘শুধু দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হলে সংবিধানের এ সব অনুচ্ছেদ স্থগিত হয়ে যায়। কিন্তু দেশে তো ঘোষিত কোনো জরুরি অবস্থাও চলছে না।’

এ সব বিষয়ে কথা বলা হলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের নির্বাহী পরিচালক বদিউল আলম মজুমদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘একটি দেশের গণতান্ত্রিক সরকার হলো সে দেশের সংবিধানের ধারক ও বাহক। কিন্তু আমরা স্বাধীনতার পর থেকে দেশে শুধু স্বৈরশাসকরাই নন সব গণতান্ত্রিক সরকার সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকারগুলো খর্ব করেছে। তবে এখন যা ঘটছে তা পূর্বেকার ঘটনাগুলো থেকেও ভয়াবহ। এখানে আইনের শাসন নেই, নাগরিকের মৌলিক অধিকারও নেই। কারোই সংবিধানের প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ নেই। আদালতের প্রতিও মানুষের সম্মান ও আস্থা কমে যাচ্ছে। এতে সংবিধান লংঘনের মতো এ সব ঘটনা ঘটছে।’

তবে পুলিশের বিরুদ্ধে সংবিধানের ২৭, ৩৬ ও ৩৭ ধারা লংঘনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম-কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম। তিনি দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘সংবিধানের এ সব ধারা মেনেই আমরা কাজ করছি। এক্ষেত্রে সংবিধান অবমাননার কোনো ঘটনা ঘটছে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে আমরা যা করছি তা সংবিধানেও উল্লেখ রয়েছে। একটু ভালো করে সংবিধানটি পড়লে সেটা বুঝতে পারবেন।’

মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে সভা-সমাবেশ বন্ধের ব্যাপারে ১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানই ডিএমপিকে এই অধিকার দিয়েছেন।’

একদিকে বিরোধী দলের মিছিল, সভা-সমাবেশে বাধা, অন্যদিকে সরকারি দলের সমর্থকদের এ সব কর্মকাণ্ডে বাধা না দেওয়া প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘বিএনপির কোনো নেতাকর্মীকে সভা-সমাবেশ করতে বাধা দেয়া হয়নি। তাদের নয়াপল্টনের দিকে যেতে পুলিশ তো বাধা দিচ্ছে না, কেন তারা যায় না। আর সরকারি দলের কেউ লাঠি বা অস্ত্র নিয়ে মিছিল-সমাবেশ করছে না।’

(দ্য রিপোর্ট/এইচআর/এইচএসএম/এনআই/শাহ/ডিসেম্বর ৩০, ২০১৩)