জোসনা জামান, দ্য রিপোর্ট : নতুন মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। বলা হয়েছে, সকল বিষয় বিবেচনা করে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের যে মুদ্রানীতি তৈরি হবে সেখানে চলতি মুদ্রানীতির অবস্থান প্রায় অপরিবর্তিত রাখা যেতে পারে। তবে নতুন মুদ্রানীতিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার ওপর বেশি জোর দেওয়া উচিত হবে।

সরকারের অর্থনৈতিক থিঙ্কট্যাংক হিসেবে পরিচিত পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) এক প্রতিবেদনে এ সব বিষয় উঠে এসেছে। এছাড়া মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বেশ কিছু ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে প্রতিবেদনে। চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সাম্প্রতিক সাধারণ ধর্মঘট এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক বৈরিভাবাপন্ন পরিস্থিতি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে হবে বড় হুমকি বলে মনে করা হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যাপক মুদ্রা বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ মানি, বেসরকারি খাতে ঋণ বৃদ্ধি, সরকারি খাতে ঋণ বৃদ্ধি প্রভৃতিকে কাজে লাগিয়ে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনকেই লক্ষ্যমাত্রা করা উচিত। মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনাকে নয়। প্রবৃদ্ধি বেশি হলে কিছুটা মূল্যস্ফীতি সহনীয় হতে পারে। তাই ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য অর্জনের জন্য মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ থেকে ৭ শতাংশ পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য এবং সেক্ষেত্রে ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি ১৭ দশমিক ২ থেকে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে। পাশাপাশি পরবর্তী মুদ্রানীতিতে সরকারি খাত এবং তৈরি পোশাক খাতে মজুরি বৃদ্ধিজনিত এবং তার ফলে অর্থনীতির অন্যান্য খাতে প্রভাবের ফলে তারল্যজনিত চাপ মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ থাকবে। এটা আশা করা যায় যে, নির্বাচনোত্তর সময়ে বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরে আসবে, সেক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা কিছুটা বাড়ানো যেতে পারে। নির্বাচনকালীন সময়েও বিনিময় হার আগের মতই থাকছে, তবে নির্বাচনোত্তর সময়ে পরিস্থিতি বিবেচনায় পুঙ্খানুপুঙ্খ তদারকি ও সমন্বয়ের প্রয়োজন হবে। মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে তা যাই হোক, প্রয়োজন হবে ব্যাংক ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবীক্ষণ ও অনুসন্ধান জোরদার করা। মুদ্রানীতিকে প্রবৃদ্ধি অর্জনে আরো সহায়ক করা।

এ বিষয়ে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. শামসুল আলম দ্য রিপোর্টকে বলেন, এই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ দুটি মুদ্রানীতির বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে। প্রতিবেদনটির প্রধান লক্ষ্য হলো মুদ্রানীতি দুটিকে সামষ্টিক অর্থনীতির আলোকে পর্যালোচনা করা ও পরবর্তী মুদ্রানীতি কেমন হতে পারে এবং কেমন হওয়া উচিৎ সে সম্পর্কে একটি পূর্বধারণা প্রদান করা। পরবর্তী মুদ্রানীতি ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। সে জন্যই এ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের (২০১৩-১৪) অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কিছু অন্তর্নিহিত ঝুঁকি বা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এগুলো অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ঝুঁকি হিসেবে অভিহিত করা যায়।

অভ্যন্তরীণ ঝুঁকির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরিবহন খাত এবং স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের গতিকে ব্যাহত করে। পরিবহন থেকে শুরু করে নির্মাণ এবং অন্যান্য সেবা সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড যেমন, হোটেল ও রেঁস্তোরা এবং পাইকারি ও খুচরা বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের চাহিদা মন্থর হয়েছে। সকল প্রকার টেকসই ও অটেকসই ক্রয়ের ক্ষেত্রে ভোক্তা চাহিদা দ্রুত পতনের কারণে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যকে প্রভাবিত রবে।

সাধারণ বিনিয়োগ পরিবেশ এবং বিশ্ব প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণে বাণিজ্যের উৎকর্ষ সাধনকে উচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করা প্রয়োজন। ব্যবসা চুক্তি কার্যকর করতে বাংলাদেশে সময় লাগে মোট ১৪০০ দিনের বেশি যা বিশ্বের সর্বোচ্চ এবং ২০১২ সালের এক জরিপে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮৩ দেশের মধ্যে ১৮২তম।

এছাড়া জমির কম সহজলভ্যতা, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সংকট, অনমনীয় শ্রম বাজার এবং লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বাংলাদেশে বিনিয়োগের প্রধান অন্তরায়। মূল্যস্ফীতিজনিত চাপ কিছুটা কমলেও এখনও উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিদ্যমান এবং তা উর্ধ্বমুখি। সরকারি খাতসহ অর্থনীতির অন্যান্য সকল খাতে মজুরি বৃদ্ধির প্রত্যাশার কারণে মজুরি বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়তে পারে এবং তা প্রবৃদ্ধির গতিকে ব্যহত না করে নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পারদর্শিতার প্রশ্ন এখানেই।

বাহ্যিক চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে- বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। প্রধানত তৈরি পোশাক খাতের পণ্যের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশের রপ্তানির বৃহৎ বাজার। এছাড়াও এ অঞ্চল এবং অন্যান্য উন্নত অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি প্রবণতা ও আমদানি চাহিদা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ। এছাড়া খাদ্য ও জ্বালানি মূল্যের সঙ্গে মূল্যস্ফীতি ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যমূল্য বাহ্যিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে পরিগণিত হয় এবং তা নিয়মিত নিবিড় তদারকির প্রয়োজন হবে।

গ্লোবাল কর্পোরেট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করা প্রয়োজন এবং বিদেশে শ্রমশক্তি রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের প্রবাহের গতি ধরে রাখার জন্য আগামী দিনগুলোতে নতুন বাজার সম্প্রসারণের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মুদ্রানীতি সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রতিবছর দুটি ষান্মাসিকে প্রকাশ করে থাকে। প্রতি অর্ধ-বছরের শুরুতে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে দেশের মুদ্রানীতি সংক্রান্ত অবস্থান এবং সংশ্লিষ্ট সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সারসংক্ষেপ উপস্থাপিত হয়। মুদ্রানীতি প্রণয়নের সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাম্প্রতিক সামষ্টিক অর্থনীতির বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ অবস্থা এবং পরবর্তী ছয় মাসের সম্ভাব্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে থাকে।

২০১২-১৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় অর্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি বিবৃতির মূল প্রতিপাদ্য ছিল মূল্যস্ফীতির পরিমাণ যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রেখে সরকারের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়তা করা। এ উদ্দেশ্য যাতে সহজেই অর্জিত হয়, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক উৎপাদনশীল বিনিয়োগের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ঋণ প্রবাহের ব্যবস্থা রেখেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সময়ে সব ধরনের রেপো রেট (সুদের হার) দশমিক ৫০ ভিত্তি অঙ্ক পরিমাণে হ্রাস করেছিল, যাতে করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিমণ্ডলে তৎকালে বিরাজমান অনিশ্চয়তা দেশের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। তদুপরি, বাংলাদেশ ব্যাংক, এর মুদ্রা ব্যবস্থাপনা কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনয়ন করে। পূর্ববর্তী অর্ধ-বছরের জন্য ধার্য ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যপক মুদ্রা প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করে ১৭ দশমিক ৭ শতাংশে নিয়ে আসা হয় এবং বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ১৮ শতাংশ থেকে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া ২০১২-১৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় অর্ধের জন্য উৎপাদনশীল খাতে অধিকতর বিনিয়োগবান্ধব ঋণ কর্মসূচি প্রচলন করা হয়। এই ভারসাম্যপূর্ণ মুদ্রানীতি, বিনিময় হারের অস্থিতিশীলতা হ্রাসের ব্যবস্থাও গ্রহণ করে। মোদ্দাকথা, এই মুদ্রানীতি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির বিপরীতমুখী সম্পর্ককে যথাসম্ভব প্রশমিত করার চেষ্টা করে।

২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম অর্ধভাগের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি, গড় মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে (পুরনো ভিত্তি বছর ধরে) নামিয়ে আনার লক্ষ্য নিয়ে প্রণীত হয়। এর অন্যতম কৌশল ছিল পর্যাপ্ত ঋণ প্রবাহ নিশ্চিত করে অন্তর্ভূক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন। এ মুদ্রানীতির সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছিল সঞ্চিত অর্থের প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৫ শতাংশে ধরে রাখা এবং ডিসেম্বর ২০১৩ এর মধ্যে ব্যাপক মুদ্রার প্রবৃদ্ধি ১৭ দশমিক ২ শতাংশে নামিয়ে আনা। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ডিসেম্বর ২০১৩ এর জন্য ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ এবং জুন ২০১৪ এর জন্য ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ব্যাংকিং খাত হতে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ ২০১৩-১৪ সালের বাজেটে বর্ণিত অঙ্কের মধ্যে সীমিত রাখার প্রয়াসও এ বিবৃতির লক্ষ্য হিসেবে উদ্ধৃত হয়েছে। এছাড়া এ মুদ্রানীতিতে পূর্ববর্তী অর্ধ-বছরে (জানুয়ারি-জুন) হ্রাসকৃত রেপো রেট (সুদের হার) বজায় রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ মুদ্রানীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় আরও বৃদ্ধির প্রত্যাশা জ্ঞাপন করা হয়। অবশ্য এ সঞ্চয় পূর্বের চেয়ে ধীরগতিতে করা হবে বলেও মতামত ব্যক্ত করা হয়। তদুপরি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সময় বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার বহাল রাখার পাশাপাশি টাকার মূল্যমানের অস্থিতিশীলতা হ্রাসের জন্যও উদ্যোগ অব্যাহত রাখে।

(দ্য রিপোর্ট/জেজে/জেএম/ডিসেম্বর ৩১, ২০১৩)