জন্মদিনও পালন করতে পারছে না ছাত্রদল
দ্য রিপোর্ট প্রতিবেদক : নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কোন্দল সত্ত্বেও বিশাল কলেবর সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। এরপরও নেতাদের এক সুতোয় গাঁথতে না পারা, কমিটি বাণিজ্য, কমিটিতে অছাত্রদের দৌরাত্ম্য, ত্যাগীদের অবমূল্যায়নসহ নানা ক্ষোভে দেশের এক সময়ের বড় ও শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল আজ ‘কাগুজে বাঘে’ পরিণত হয়েছে। তাই ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া সংগঠন ছাত্রদল এই প্রথম নিজের জন্মদিনও পালন করতে পারছে না।
নিজেদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও সাধারণ কর্মী বিশেষ করে প্রকৃত ছাত্রদের সংগঠনের প্রতি আকৃষ্ট করতে না পারাই ছাত্রদলের বর্তমান হীনবল হওয়ার প্রকৃত কারণ বলে অভিজ্ঞরা মনে করছেন।
অবশ্য ছাত্রদলের বর্তমান কমিটির দপ্তর সম্পাদক নাজমুল হাসান দ্যরিপোর্টকে বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতাই ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন না করার মূল কারণ।
অভিজ্ঞদের মতে, আদর্শ থেকে সরে আসা, প্রকৃত ছাত্রদের দিয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংগঠনের কমিটি না করা, দীর্ঘদিন কাউন্সিল না হওয়া, জেনারেশন গ্যাপ, নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে নজর না দেওয়া, অঞ্চল ও গ্রুপভিত্তিক অছাত্র ও অর্থের বিনিময়ে কমিটি গঠনে প্রধান্য দেওয়া, সর্বোপরি ‘তথাকথিত ভাইয়াদের’ প্রভাব বলয় তৈরির কারণে বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সরকারবিরোধী আন্দোলনে প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন।
ছাত্র রাজনীতির সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল হক এ ব্যাপারে দ্যরিপোর্টকে বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদলের ভূমিকা ছিল গৌরবোজ্জ্বল। সেই সময়ের সঙ্গে এখনকার ছাত্রদলের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। এখনকার ছাত্রদলের ভূমিকা অত্যন্ত লজ্জাকর। তিনি বলেন, প্রতিবছর নতুন নেতৃত্ব না আসায় গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে। যারা নেতৃত্বে আসছে, তাদের সিংহভাগই ছাত্র নয়। অছাত্র। এদের বেশিরভাগই সংসারী। সন্তানের বাবা। তাই কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে এরা সাহসী হতে পারে না। সারাক্ষণ নানা ভয়-ভীতি এদের মধ্যে কাজ করে। এ জন্য সংগঠনের জন্য কাজ না করে এরা নিজেদের রক্ষায় ব্যস্ত থাকে।
অধ্যাপক ওবায়দুল বলেন, ছাত্রদলের কমিটি গঠনের ব্যাপারে দলের হাইকমান্ডকে ভুল বোঝানো হয়। অনেকে বিশেষ প্রভাব থেকে বের হতে পারে না। তাই ছাত্রদল আর ছাত্রদল নেই। এখন তা ভাইয়াদের দলে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, অনেকেই আমাদের বলে, স্যার আমি ওমুক ভাইয়ার গ্রুপ করি। আমরা বলি গ্রুপ কেন, তুমি ছাত্রদলের হতে চেষ্টা কর। এটা আসলে লজ্জার ব্যাপার।
তিনি আরও বলেন, ছাত্রদল নিঃশেষ হয়ে গেছে। নিষিদ্ধ সংগঠনের আকার ধারণ করেছে। এর কারণ তারা পরিচয়হীন। কোনো মিছিল-মিটিংয়ে যোগ দেওয়ার আগে তারা ভয়ে থাকে, কারণ তাদের পরিচয় নেই। পুলিশ তাদের ধরে শিবির বা হিযবুত বানিয়ে মামলা দেয়।
এ থেকে উত্তোরণ ঘটাতে ছাত্রদলকে বুড়ো, সংসারী, অছাত্রদের বাদ দিয়ে প্রকৃত ছাত্রদের দিয়ে কমিটি করতে হবে। ঢাবিতে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে হবে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় কমিটিতে কোনো অছাত্রকে স্থান দেওয়া যাবে না। নেতৃত্ব দিয়েই নতুনদের ছাত্র রাজনীতিতে উৎসাহিত করতে হবে। তিনি এ ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের প্রশংসা করে বলেন, তারা অন্তত প্রকৃত ছাত্র ও বয়সের বিষয়ে একটি সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. পিয়াস করিম দ্যরিপোর্টকে বলেন, ছাত্রদলের এ ব্যর্থতা খুঁজে বের করতে সংগঠনকে গভীরভাবে কাজ করতে হবে। প্রকৃত ছাত্রদেরকে সংগঠনের নেতৃত্বে আনতে হবে। কোনো অছাত্রদের সংগঠনে রাখা যাবে না।
ড. পিয়াস করিম বলেন, প্রকৃতপক্ষে আমার মনে হয়, আদর্শ থেকে সরে আসাই আজকে ছাত্রদলের এ পরিণতির জন্য দায়ী। ছাত্রদলকে আদর্শের প্রতি নজর দিতে হবে।
জানা গেছে, সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিভিন্ন গ্রুপের সমন্বয়হীনতা, ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না করা, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন না করা এবং নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ করতে না পারার কারণে রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না সংগঠনটি।
বর্তমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদলের ভূমিকা নিয়ে কিছুটা দুঃখ প্রকাশ করে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদ গ্রেফতারের দুদিন আগে দ্যরিপোর্টকে বলেন, এ বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক যে, ছাত্রদল অতীতের সেই গৌরবোজ্জল ঐতিহ্যের মধ্যে নেই। এ দেশের ইতিহাসে ছাত্ররাজনীতির যে ঐতিহ্য তার পুরোধাই ছিল জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। বিশেষ করে দেশের গণতন্ত্রের জন্য, স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদল অন্য ছাত্র সংগঠনের নেতার ভূমিকা রেখেছে। যা আজ হারাতে বসেছে।
রিজভী বলেন, ছাত্রদল নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ভাই আমাকে আগে দুঃখ প্রকাশ করে বলতেন, রিজভী তোমাদের ছাত্রদলকে নিয়ে আমার অহংকার হয়। কী চমৎকার সব ছেলে-মেয়ে। সবাই চমৎকার স্মার্ট। দেখলে হিংসে হয়। রিজভী বলেন, তবে এখন কী সেই অহংকার করার মতো অবস্থা আমাদের (ছাত্রদল) আছে? মনে হয় যেন ছাত্রদল নিষিদ্ধ সংগঠনে পরিণত হয়েছে।
জানা যায়, ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে ছাত্রদল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ দেশের ইতিহাসের সকল আন্দোলন সংগ্রামে রাজপথে নেতৃত্ব প্রদানে সক্ষম হয় ছাত্রদল। আন্দোলন সংগ্রামে সফলতার সঙ্গে নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের স্বীকৃতিও পায়। এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সংগঠনটি।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নিজে দায়িত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন যাচাই-বাছাই শেষে আব্দুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েলকে সভাপতি ও হাবিবুর রশিদ হাবিবকে সাধারণ সম্পাদক করে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করেন। কমিটি অনুমোদনের সময় বিগত দিনে দলে বিদ্যমান বিভিন্ন গ্রপের নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাইকমান্ডের নির্দেশনা মোতাবেক সকল গ্রুপের সমন্বয়ে কমিটি করতে গিয়ে ২৯৪ সদস্যের কমিটি করতে হয়। ওই সকল গ্রুপের নেতাদের প্রাধান্য দিতে গিয়ে বিশাল কমিটিতেও দলের অসংখ্য ত্যাগী নেতাকর্মী পদবঞ্চিত হয়েছেন। কিন্তু কমিটিতে পদ পাওয়ার পর বিভিন্ন গ্রুপ থেকে আসা ওই সকল নেতারা তাদের গ্রুপের প্রধানের এজেন্ডা বাস্তবায়নের কাজেই অধিক ব্যস্ত থাকছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া কমিটিতে অছাত্র, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও সিনিয়র জুনিয়র প্রটোকল মেইনটেইন না করে পদ দেওয়ায় অনেকে নাখোশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের এমফিলের ছাত্র, ছাত্রদল কেন্দ্রীয় কমিটিরসহ গণশিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক শেখ হাসানুল বান্না দ্যরিপোর্টকে বলেন, ছাত্রদলকে প্রকৃত ও মেধাবী ছাত্রদের নেতৃত্বে আনতে হবে। ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে সোচ্চার হতে হবে। তাহলেই দেশের ছাত্রসমাজের ওপর ছাত্রদল আবার প্রভাব বিস্তার করতে পারবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মাহমুদুল হক হিমেল ছাত্রদলের ব্যর্থতা সম্পর্কে দ্যরিপোর্টকে জানান, অতীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দলীয় পদে অধিষ্ঠিত হয়েও বর্তমান কমিটিতে পদবঞ্চিত হয়েছেন তিনি। এরপরও নেতাদের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রদলের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে চলেছেন।
ঢাবি ছাত্রদলের অত্যন্ত পরিচিত মুখ হিমেল বলেন, হরতাল ধর্মঘটের মতো ঝুঁকিপূর্ণ দলীয় কর্মসূচিতে পদ পজিশন ছাড়া যেতে আর ইচ্ছে হয় না। পদ না থাকলে এ ধরনের কর্মসূচিতে কোনো ধরনের বিপদ আসলে কেউ দায়িত্ব নিতে চান না। তিনি জানান, ঢাবি ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় পুলিশ আমাদের ছাত্রদলের কোনো নেতাকর্মীকে ধরলেই ছাত্রশিবির বা হিযবুত বানিয়ে মামলা দেয়। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখ ও লজ্জার ব্যাপার।
এ ছাড়াও কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের পাঁচ জন করে নেতা নির্বাচন করেছিলেন খালেদা জিয়া। কিন্তু দীর্ঘদিন পরও এ সব ইউনিটের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি ইউনিট নেতারা। তাই পদ ছাড়া এ সব ইউনিটের নেতাকর্মীরা হরতাল ধর্মঘটসহ ঝুঁকিপূর্ণ কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে চাচ্ছেন না।
ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল হক নাসির দ্যরিপোর্টকে বলেন, ছাত্রদল অতীতের পথ অনুসরণ করে আন্দোলন সংগ্রামে ভূমিকা রেখে চলেছে। এ মুহূর্তে সর্বশক্তি দিয়ে দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নের জোর চেষ্টা চালাচ্ছি। এ ছাড়া খুব শিগগিরই দলের জন্য ত্যাগী ও যোগ্য পদবঞ্চিতদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পাশাপাশি ইউনিট কমিটিগুলো পূর্নাঙ্গ করার জন্যও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
নাসির বলেন, কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেও যারা আন্দোলন সংগ্রামে সাড়া দিচ্ছেন না তাদের বিষয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। রিপোর্ট/ টিএস-এমএইচ/সা/