২০১৩ সালে বেশ কয়েকটি ঘটনায় বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়েছে বাংলাদেশ। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি, মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, নির্বাচন, হরতাল, সহিংসতা, পদ্মা সেতু, গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউনূস ইত্যাদি নেতিবাচক বিষয় নিয়ে বিশ্বব্যাপী সারা বছরই আলোচনা-সমালোচনায় ছিল বাংলাদেশ। তবে এর পাশাপাশি সমুদ্র সীমা নির্ধারণ, জলবায়ু পরিস্থিতি মোকাবেলা ইত্যাদি বিষয়ে বেশ ইতিবাচক আলোচিত দিকও ছিল।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের ইতিহাসে একটি শোকাবহ দিন। এ দিন রাজধানী ঢাকার অদূরে সাভারে ৯ তলা ভবন রানা প্লাজা ধসে নিহত হন অন্তত ১১৩৪ শ্রমিক। আহত হয়েছেন আড়াই হাজারেরও বেশি, নিখোঁজ অন্তত ২০০ শ্রমিক।

সারাবিশ্বে এ হৃদয়বিদারক ঘটনাটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। বিশ্বের সকল নামিদামি মিডিয়া, সংগঠন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ নিয়মিত এ ঘটনার খোঁজখবর নেন। সব গণমাধ্যমেই শিরোনাম হিসেবে প্রকাশিত হয় ইতিহাসের অন্যতম মানবসৃষ্ট এ দুর্ঘটনা। মানবাধিকার ও বিশ্বসংস্থাগুলো সহযোগিতার পাশাপাশি সরকারি নীতিমালারও ব্যাপক সমালোচনা করে।

বিশ্বের অন্যান্য ঘটনাকে পেছনে ফেলে ‘রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি’ টাইম ম্যাগাজিনের জরিপে ২০১৩ সালের সেরা ১০টি ঘটনার মধ্যে স্থান করে নেয়। তালিকার সপ্তম স্থানে আছে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনা।

রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে ১৭ দিন পর রেশমা নামে এক গার্মেন্টসকর্মীর জীবিত বেরিয়ে আসার ঘটনাটি বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিশ্বের গণমাধ্যমগুলো একে ‘অবিশ্বাস্য’ ও ইতিহাসের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে। বিভিন্ন দেশের নানা প্রতিষ্ঠান রেশমাকে তাদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার আহ্বান জানায়।

রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর বছরজুড়ে সবচেয়ে আলোচিত ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ। বিচার প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সমালোচনা করে আসছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। বিচারের স্বচ্ছতা, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন ও মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার অভিযোগ তুলে এর সমালোচনা করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিভিন্ন সময় জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, পাকিস্তানও এ বিষয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করে।

মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার, রায় ও কার্যকরের বিষয়গুলো বছরব্যাপী আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোতে গুরুত্বসহকারে প্রকাশ পায়। বিশেষত কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের আগে তা বন্ধে জাতিসংঘ মহাসচিব, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক ও পাকিস্তানের জোরালো ভূমিকা বাংলাদেশকে আবারও আলোচনায় আনে।

ইকোনমিস্টে প্রকাশিত ট্রাইব্যুনালের বিচারকের স্কাইপি কথোপকথনও বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে।

গত বছরের শুরুর দিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে প্রথম রায় হিসেবে কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে শাহবাগে নামে হাজারো তরুণ। কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে এ আন্দোলনে শরিক হয় আপামর জনতা। এ ঘটনাটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সাড়া ফেলে। বিশ্বের ছোট-বড় সব গণমাধ্যমে গুরুত্বসহকারে প্রকাশ হয় এটি। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করা এ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা।

শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের এ আন্দোলন পরবর্তী সময়ে কিছুটা বিতর্কিত হওয়ায় আত্মপ্রকাশ ঘটে হেফাজতে ইসলাম নামে একটি দলের। ৫ মে তাদের আন্দোলনে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে প্রায় ৪০ লাখ লোক শরিক হয় বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হয়েছে। ওই রাতে তাদের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চালানো অভিযান বিশ্বব্যাপী সমালোচিত হয়। বিশ্বের সব গণমাধ্যম এটিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করে।

বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ ওই রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে ৬১ জন নিহতের সংবাদ প্রকাশ করে। যদিও আড়াই হাজারেরও বেশি কর্মী নিহতের দাবি করেছে হেফাজত। অধিকারের ওই সংবাদ প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে পত্রিকাটির সম্পাদক আদিলুর রহমানকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাকে গ্রেফতারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও ঘটনাটি ব্যাপক সমালোচিত হয়।

বাংলাদেশের দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকার এবং বিরোধী দলের অবস্থান ও টানাপোড়েন ছিল বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচিত ও সমালোচিত বিষয়। এই প্রথমবারের মতো কোনো ইস্যুতে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সব দেশের কূটনীতিকরা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। পাশাপাশি বিশ্বের সব গণমাধ্যমেই এ বিষয়ে নিয়মিত সংবাদ ও বিশ্লেষণ প্রকাশ হয়।

দুই নেত্রীর ফোনালাপ, প্রধানমন্ত্রীর একগুয়েমি, বিরোধী দলের নির্বাচন বর্জন, একদলীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয় বেশ গুরুত্বের সঙ্গে গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত হয়। এ বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের কংগ্রেসেও আলোচনা হয়। বিভিন্ন সময় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত।

এর মধ্যে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের সঙ্গে উভয় নেত্রীর ফোনালাপ ও সংস্থাটির সহকারী মহাসচিব তারানকোর দুইবার ঢাকা সফর ও রাজনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক বেশ আলোচিত হয়।

নির্দলীয় ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিরোধী দলের আন্দোলন, হরতাল, সহিংসতার ঘটনা বিশ্বের গণমাধ্যমসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পায়। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মারমুখো আচরণ বিশ্বব্যাপী নিন্দিত হয়। সরকারের দমন-পীড়নের সমালোচনা করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি বিশ্ব মহলে বেশ আলোচনার সৃষ্টি করে। পদ্মা সেতু ইস্যুতে বিশ্বব্যাংকের পিছুটানে সরকারের ভূমিকা বেশ সমালোচিত হয়। এ সময় আলোচনায় ওঠে আসে সরকারের দুর্নীতি। শেষ পর্যন্ত এ ইস্যুতে সরকারের একগুয়েমি ও সেতু তৈরির অপারগতা বিশ্বব্যাপী সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে।

গ্রামীণ ব্যাংক আইন সংশোধন ও এর প্রধানের পদ থেকে নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসকে অপসারণ বহির্বিশ্বে বেশ আলোচিত হয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশ সরকারকে নমনীয় হওয়ার আহ্বান জানায়। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। নানা দেশে ড. ইউনূসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্যও সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে।

এ ছাড়া বিডিআর বিদ্রোহে পিলখানায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার ঘটনায় ১৫২ জনের ফাঁসির রায়ও বিশ্বব্যাপী আলোচিত হয়।

এ সব নেতিবাচক খবরের পাশাপাশি বাংলাদেশ বেশ কিছু ইতিবাচক বিষয়েও আলোচিত হয়। এর মধ্যে অন্যতম হলো বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের ভূমিকা। ওপিসিডব্লিউসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে আছে বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বড় দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে বাংলাদেশের অগ্রণী ভূমিকা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়।

জাতিসংঘে মিয়ানমারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা নিয়ে মামলায় বাংলাদেশের জয় একটি অন্যতম আলোচিত বিষয়। এটি বিশ্ব অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান আরেক ধাপ এগিয়ে দেয়। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনে বিজয় লাভ বাংলাদেশর জন্য কূটনৈতিক দিক থেকে একটি বিশাল অর্জন।

এ সব বিষয় ছাড়াও খেলাধুলা, চলচ্চিত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিতই আলোচনায় ছিল বাংলাদেশ। ক্রিকেট ছাড়াও গলফ ও অ্যাথলেটিকসেও বাংলাদেশের নাম দেশের বাইরে উচ্চারিত হয়। এ ছাড়া সম্প্রতি ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল বাংলাদেশে আসাও একটি বড় ঘটনা। তবে খেলাধুলার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল যথারীতি ক্রিকেট। আগামী বছর টুয়েন্টি-২০ বিশ্বকাপের আয়োজক বাংলাদেশ ক্রিকেট মহলে বেশ আলোচিত থাকবে তা বলাবাহুল্য। তবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে বিশ্বকাপ আয়োজনের বিষয়টি হুমকির মধ্যে ফেলেছে। এ বছর অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এ শঙ্কাও বেশ আলোচিত ছিল।

(দ্য রিপোর্ট/এসকে/সা/শাহ/জানুয়ারি ০১, ২০১৪)