৬ বার প্রথম হয়ে আলোচিত কাদের মোল্লা!
বর্তমান ক্ষমতাসীন জোট নির্বাচনের আগে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বর্তমান সরকারের সময় কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর রায় ঘোষণা করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে সর্বোচ্চ সাজাপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার রায়ও কার্যকর হয়েছে।
কাদের মোল্লার রায়কে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালে সবচেয়ে বেশি আলোচনা এবং ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয় মানবতাবিরোধী অপরাধের রায়ে ইতিহাসে ৬টি দিক দিয়ে তিনি প্রথম স্থান দখল করে রেখেছেন।
কাদের মোল্লার রায় প্রথম ঘোষণা :
মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের মধ্যে কাদের মোল্লার রায় সর্বপ্রথম ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন। এর আগে আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষে তার আইনজীবীদের ও রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটরের যুক্তি উপস্থাপন শেষ হলে ১৭ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই মামলার রায়ের দিন (সিএভি) যে কোনো দিন ঘোষণার জন্য ধার্য করেন।
প্রথম গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি :
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় ঘোষণার পর কাদের মোল্লা হাত তুলে ভি-সাইন (বিজয় চিহ্ন) দেখিয়েছিলেন। তার উদ্ধৃত আঙুল সব মুক্তিকামী মানুষের মনে অপমানবোধ ছড়িয়ে দিয়েছিল। দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করেন ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্রমৈত্রীসহ বিভিন্ন বামপন্থী, প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত হয়, রায় প্রত্যাখ্যান করে সন্ধ্যায় মশাল মিছিল করা হবে। মিছিলটি শাহবাগ থেকে শুরু হয়ে বাংলামোটর ঘুরে শাহবাগ হয়ে অপরাজেয় বাংলায় ফিরবে।
বিকেলে শাহবাগে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করে ব্লগার অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের (বোয়ান) জনা তিরিশেক কর্মী। বোয়ানের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আজকের গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার। বোয়ানের মানববন্ধন যখন শেষ হয় তখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই। সে সময় বিশাল মশাল মিছিল নিয়ে বামপন্থী বিভিন্ন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের বর্তমান ও সাবেক নেতাকর্মীরা শাহবাগ প্রদক্ষিণ করছিলেন। মিছিলটি বাংলামোটর হয়ে ফিরতি পথে শাহবাগে এসে অবস্থান নেয়। শুরু হয় ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ হিসেবে খ্যাত শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন। তখনই কাদের মোল্লার এই রায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রথম গণজাগরণ মঞ্চের সৃষ্টি হয়।
প্রথম ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধন :
শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন ও দাবির মুখে ফেব্রুয়ারির ১৩ তারিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ সংশোধন করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। শুরু হয় কাদের মোল্লার রায়ের পুনর্বিবেচনা।
রায় কার্যকরের দিন ঘোষণা :
সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দণ্ড না দেওয়ায় ও একটি অপরাধের অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়ায় সাজা বাড়ানোর জন্য এ রায়ের বিরুদ্ধে ৩ মার্চ আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। আপিলে ওই ৫টি অভিযোগে দেওয়া সাজা অপর্যাপ্ত দাবি করে ও খালাসের আদেশ বাতিল চেয়ে সর্বোচ্চ দণ্ড ফাঁসির আরজি জানানো হয়। ৪ মার্চ প্রমাণিত সব অভিযোগ থেকে খালাসের আবেদন জানিয়ে আপিল করেন আব্দুল কাদের মোল্লার পক্ষে তার আইনজীবী।
১ এপ্রিল থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত ও ৬ জুন থেকে ২০ জুন পর্যন্ত মোট ১৪ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের সমন্বয়ক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান। অন্যদিকে ২৯ এপ্রিল থেকে ৬ জুন পর্যন্ত ১৮ কার্যদিবসে আসামিপক্ষের শুনানি করেন ডিফেন্সের প্রধান আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।
২২ জুলাই এই মামলায় সাত অ্যামিকাস কিউরি ও কাদের মোল্লার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্য উপস্থাপন শেষ হয়। আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষ মিলে সর্বমোট ৩৯ কার্যদিবসে তাদের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত ৫ সদস্যের আপিল বিভাগ অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রেখে আদেশ দেন। ২৩ জুলাই কাদের মোল্লার আপিলের রায় যে কোনো দিন ঘোষণা করা হবে মর্মে অপেক্ষমাণ রাখেন আপিল বিভাগ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় ৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ কর্তৃক ৭৯০ পৃষ্ঠার এ রায় প্রকাশ করা হয়। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতারভিত্তিতে তার (কাদের) বিরুদ্ধে আনীত ষষ্ঠ অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেন। বিচারপতি ওয়াহাব মিঞা মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পক্ষে মত দেন। বাকি চারজন মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে মত প্রদান করেন।
এরপর ৮ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের রায় ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। ওই দিনই কাদের মোল্লার মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে তা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান ট্রাইব্যুনাল কর্তৃপক্ষ। অতপর ১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ও আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড ওই দিনই কার্যকর করা হবে বলে জানান।
মৃত্যুদণ্ডের আদেশ সর্বপ্রথম স্থগিত :
১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ও আইন প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড ওই দিনই কার্যকর করা হবে বলে গণমাধ্যমকে জানানোর পর রাতেই আসামিপক্ষের আইনজীবীরা আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে গিয়ে কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করতে আদেশ নেন। অনেক নাটকীয়তার পর রাত ১০টার দিকে চেম্বার জজ আদালতের বিচারক সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় বুধবার সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত স্থগিত করা হয়।
সর্বপ্রথম কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর :
১০ ডিসেম্বর রাতে চেম্বার আদালত কর্তৃক দেওয়া কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর স্থগিতের আদেশের পর, ১১ ডিসেম্বর সকালে আপিল বিভাগের ৫ সদস্যের বেঞ্চে রিভিউ গ্রহণ করা হবে কিনা, সে ব্যাপারে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। রিভিউ শুনানি ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুলতবি করেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ৫ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। পরবর্তীতে ১২ ডিসেম্বর আদালত রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেন। সুতরাং আদালতের পক্ষ থেকে কাদের মোল্লার রায় কার্যকর করতে কোন বাধাই থাকে না। পরে ওই রাতেই ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়।
(দ্য রিপোর্ট/এসআর/এসবি/সা/শাহ/জানুয়ারি ০১, ২০১৪)