জনশক্তি রফতানিতে ধস
জনশক্তি রফতানিতে ব্যাপক ধস নেমেছে। ২০১২ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে জনশক্তি রফতানি হয় ৬ লাখ ৭ হাজার ৭৯৮ জন। ২০১৩ সালে তা কমে রফতানি হয়েছে ৪ লাখ ৩ হাজার ৮১৩ জন। যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৩ হাজার ৭৮৫ জন কম।
জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে ধস নেমেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। ২০১২ সালে দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী পাঠানো হয়েছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ জন। আর ২০১৩ সালে গেছে মাত্র ১৩ হাজার ৯৯৩ জন।
এ ছাড়া ২০১২ সালের চেয়ে ২০১৩ সালে জনশক্তি রফতানি কমেছে সৌদি আরব ও ওমানসহ আরও কয়েকটি দেশে। তবে মালয়েশিয়াসহ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশি শ্রমবাজার উন্মুক্ত হয়েছে ২০১৩ সালে।
২০১২ সালের তুলনায় ২০১৩ সালে বিদেশে কম কর্মী পাঠানোকে সরকার বা মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন না প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। বরং বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাকেই দায়ী করেছেন তিনি।
মূলত সংযুক্ত আরব আমিরাতে জনশক্তি রফতানি কমে যাওয়ায় এ খাতে এই বিপর্যয়। দ্বিতীয় বৃহৎ শ্রম বাজারের দেশটিতে বিগত ২০১২ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকেই ব্যাপক হারে বাংলাদেশি কর্মী নেওয়া বন্ধ রয়েছে। অন্যদিকে বৃহৎ শ্রম বাজার সৌদি আরবও ২০০৮ সালের পর থেকে ব্যাপক হারে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, কূটনৈতিক ব্যর্থতা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অদক্ষতা ও জনশক্তি রফতানিকারক কিছু প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার কারণে জনশক্তি রফতানিতে এ বিপর্যয় নেমে এসেছে। কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধিসহ দূতাবাসগুলোর কর্মকর্তাদের সক্রিয় ভূমিকা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তারা।
তবে ২০১২ সালের চেয়ে ২০১৩ সালে জনশক্তি রফতানি কমেছে বিষয়টি স্বীকার করলেও এটিকে ব্যর্থ হিসেবে মেনে নিতে নারাজ প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণে আমরা আশঙ্কায় ছিলাম বিদেশ থেকে জনশক্তি ফিরে আসবে। কিন্তু তা হয়নি। তবে ২০১৪ সালে চার লক্ষাধিক মানুষ বিদেশে পাঠানো সম্ভব হবে বলে মনে করছি।’
২০১২ সালে ৬ লাখ মানুষ বিদেশ পাঠানো হয়েছে। ২০১৩ সালে তা কম হওয়া ব্যর্থতা কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘এটা ব্যর্থতা নয়, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার কারণেই এমনটা হয়েছে।’
ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিগত চারদলীয় জোট সরকারের ৫ বছরে ১৩ লাখ লোক বিদেশে পাঠানো হয়েছে। আর বর্তমান সরকারের ৫ বছরে লোক গেছে ২৪ লাখ। যা তাদের আমলের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।’
বাংলাদেশের বৃহত্তম শ্রমবাজার সৌদি আরব বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি দীর্ঘদিন বন্ধ রাখার পর একমাত্র আরব আমিরাতই সেই ক্ষতি পুষিয়ে দিচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে আরব আমিরাত বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় বড় ধরনের হোঁচট খেতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
বিএমইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১২ সালে বিদেশে ৬ লাখ ৭ হাজার ৭৯৮ জন বাংলাদেশী শ্রমিক পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৬৭ হাজার ৭৩৮, ফেব্রুয়ারিতে ৬০ হাজার ৪৪১, মার্চে ৫৮ হাজার ১০২, এপ্রিলে ৬৩ হাজার ১৭৫, মে মাসে ৭২ হাজার ২৭১, জুনে ৫৩ হাজার ১১০, জুলাইতে ৬২ হাজার ৭১৩, আগস্টে ৪৩ হাজার ৭৭৩, সেপ্টেম্বরে ৩৩ হাজার ১৬১, অক্টোবরে ২৯ হাজার ৬২৪, নভেম্বরে ৩১ হাজার ২৮১ এবং ডিসেম্বর মাসে ৩২ হাজার ৪০৯ কর্মী বিদেশে গেছেন।
২০১৩ সালে শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাতেই বাংলাদেশি শ্রমিক গেছেন ২ লাখ ১৫ হাজার ৪৫২ জন। এ ছাড়া ওমানে ১ লাখ ৭০ হাজার ৩২৬, সৌদি আরবে ২১ হাজার ২১২, কাতারে ২৮ হাজার ৮০১, বাহরাইনে ২১ হাজার ৭৭৭, লেবাননে ১৪ হাজার ৮৬৪, জর্ডানে ১১ হাজার ৭২৬, লিবিয়ায় ১৪ হাজার ৯৭৫, সিঙ্গাপুরে ৫৮ হাজার ৬৫৭ ও ইতালিতে ৯ হাজার ২৮০ জন গেছেন।
বিএমইটির হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে ৪ লাখ ৩ হাজার ৮১৩ কর্মী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ৩৮ হাজার ৩৩৭, ফেব্রুয়ারিতে ৩২ হাজার ১৮৯, মার্চে ৩৭ হাজার ১০০, এপ্রিলে ৩২ হাজার ২৮১, মে মাসে ৩৪ হাজার ৩৭০, জুনে ৩৪ হাজার ৬৩, জুলাইতে ৩৭ হাজার ৯৭, আগস্টে ২৭ হাজার ৯৪৯, সেপ্টেম্বরে ৩৫ হাজার ২০৩, অক্টোবরে ৩৩ হাজার ৬৩০, নভেম্বরে ২৯ হাজার ৪২৮ এবং ডিসেম্বরে (২৪ তারিখ পর্যন্ত) ৩২ হাজার ১৪৬ জন বিদেশ গেছেন।
এ সব দেশের মধ্যে মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশী শ্রমবাজার সৃষ্টি হওয়ায় সেখানে ২০১৩ সালে লোক গেছে ৩ হাজার ৬৩৫ জন। আগের বছর (২০১২) এ সংখ্যা ছিল ৮০৪ জন।
২০১৩ সালে সবচেয়ে বেশি জনশক্তি রফতানি হয়েছে ওমানে। সেখানে ১ লাখ ৩২ হাজার ১৩১ কর্মী পাঠানো সম্ভব হয়েছে।
এ ছাড়া সৌদি আরবে ১২ হাজার ৬৪০ জন, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১৪ হাজার ৯৩, কাতারে ৫৬ হাজার ৮১৯, বাহরাইনে ২৪ হাজার ৯০৯, লেবাননে ১৪ হাজার ৮৭৯, জর্ডানে ২১ হাজার ৯৯, লিবিয়ায় ৭ হাজার ১৭৫, সিঙ্গাপুরে ৫৯ হাজার ৫১২ কর্মী গেছেন।
বর্তমান সরকারের আমলে নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে দাবি করেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘বিএনপি জোটের সময় ৯৭টি দেশে জনশক্তি রফতানি হতো। এখন ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশি কর্মী যাচ্ছেন। আমরা নতুন করে ৬০টি দেশে জনশক্তি রফতানির বাজার তৈরি করেছি। ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে উঠলে ব্যাপক হারে বিদেশে লোক পাঠাতে সক্ষম হব।’
(দ্য রিপোর্ট/কেএ/এনডিএস/এসআই/জানুয়ারি ০১, ২০১৪)