আন্দোলনে ব্যর্থ মহানগর বিএনপি
তারেক সালমান ও মাহমুদুল হাসান, দ্য রিপোর্ট : সরকারের শেষ সময়েও আন্দোলন জমাতে পারছে না ঢাকা মহানগর বিএনপি। মহানগর কমিটির ব্যর্থতার কারণেই সর্বশেষ আলোচিত সরকারবিরোধী ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচিতে রাজপথে কোনো নেতাকর্মীর তৎপরতা ছিল না বললেই চলে।
নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং ঘোষিত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রতিহতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া আন্দোলন ঘোষণা দিলেও ঢাকা মহানগর কমিটির অতীত কর্মকাণ্ড দেখে সাফল্যের ব্যাপারে সবাই সন্দিহান। আর মহানগরের ব্যর্থতার ঢেউ সারাদেশের নেতাকর্মীদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন।
সূত্র জানায়, নেতাদের দ্বন্দ্ব-বিবাদ, সংস্কারপন্থি ইস্যু, দীর্ঘ সময়েও পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় সাংগঠনিক দুর্বলতা, দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে অনীহা, নেতাদের গা বাঁচানোর চেষ্টায় প্রতিনিয়তই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে মহানগর বিএনপির নেতৃত্ব।
২০১১ এর ১৪ মে সাদেক হোসেন খোকাকে আহ্বায়ক ও আবদুস সালামকে সদস্য সচিব করে ঢাকা মহানগর বিএনপির ২১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। আহ্বায়ক কমিটিকে পরবর্তী সময়ে ৫ মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু আড়াই বছরের বেশি সময় পার হলেও দলীয় প্রধানের নির্দেশ বাস্তবায়ন হয়নি। এ নিয়ে স্বয়ং খালেদা জিয়া চরম অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
মহানগর সূত্রে জানা গেছে, আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর এ পর্যন্ত মাত্র কয়েকটি ওয়ার্ড ও থানায় কাউন্সিল ও কমিটি করা হলেও বাকি ওয়ার্ড-থানাগুলোতে বিরোধের কারণে কমিটি করতে পারেনি মহানগর নেতারা। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও খোকার বাইরেও এলাকা ভেদে কারাবন্দি বিএনপি নেতা নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আবদুল কাইয়ুম, সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ও নবিউল্লাহ নবীর গ্রুপিং এবং কোন্দলের কারণে ঢাকা মহানগরীর তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি পুনর্গঠন করতে পারছে না।
মহানগর বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, সারাদেশে মূল দল বিএনপির ৭৮টি সাংগঠনিক ইউনিট রয়েছে। ঢাকা মহানগর বিএনপি ইউনিটকে সবচেয়ে শক্তিশালী হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু এ ইউনিটটিই বর্তমানে সবচেয়ে দুর্বল আর কোন্দলপূর্ণ হিসেবে দলের সাধারণ নেতাকর্মী থেকে শুরু করে হাইকমান্ড পর্যন্ত চিহ্নিত হয়েছে।
এ সব কারণে শুনানির মাধ্যমে থানা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয় নগর বিএনপির তিন যুগ্ম-আহ্বায়ক এম এ কাইয়ুম, কাজী আবুল বাশার, আলী আজগর মাতাব্বরকে। তারা ওয়ার্ড পর্যায়ে বেশ কিছু কমিটি গঠন করতে পারলেও ঢাকার ৪৯টি থানার মধ্যে বেশিরভাগ কমিটি ঘোষণা করতে পারেননি। এখন পর্যন্ত মাত্র ২৪টি থানার কমিটি ঘোষণা করেছে মহানগর বিএনপি। তবে ঘোষিত এ সব কমিটিতে ঢাকার রাজনীতিতে প্রভাবশালী মির্জা আব্বাসের অনুসারীদের সন্মানজনক অবস্থান না থাকায় কোন্দল নিরসন হয়নি। বরং অনেকাংশে বেড়েছে। এ জন্য আব্বাস অনুসারীরা পাল্টা কমিটি গঠনের চিন্তা করছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
মহানগর বিএনপির দফতরের দেখভাল করা নেতা জাকির হোসেন জানান, এখন পর্যন্ত ২৪ থানার কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে কোনো ওয়ার্ড কমিটি এখনও পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।
কমিটি গঠনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম-আহ্বায়ক এমএ কাইয়ুম জানান, শুনানি করে অনেকগুলো থানা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া ১২টি ইউনিয়নেরও শুনানি হয়েছে। সবগুলোর রিপোর্ট বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দেখে কমিটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
আব্বাস অনুসারী হিসেবে পরিচিত মহানগর বিএনপির ১ নম্বর যুগ্ম-আহ্বায়ক সালাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, আহ্বায়ক কমিটিতে থাকার পরেও কারো সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই একতরফা কমিটি গঠনের চেষ্টা হচ্ছে। যাতে ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দেওয়া হচ্ছে। ফলে আন্দোলন সফল হচ্ছে না। এ জন্য সবার গ্রহণযোগ্য কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
ওয়ার্ড পর্যায়ের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সরকারের শেষ সময়ে মহানগরীতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেওয়ার কথা। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে ঢাকা মহানগর বিএনপি। সেই আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়বে সারাদেশে। কিন্তু রাজধানীতেই আন্দোলন জমাতে পারছি না আমরা। এ জন্য মহানগরের প্রভাবশালী নেতাদের দ্বন্দ্ব-কোন্দলই দায়ী। মহানগর বিএনপির সব নেতাই মামলা-হামলার ধুয়া তুলে গা বাঁচিয়ে চলছেন। কর্মীরাও নেতাদের এ হাল দেখে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সাবেক কমিশনার বলেন, ‘কর্মসূচিগুলোতে মহানগর নেতাদের মাঠে থাকার জন্য বার বার নির্দেশ দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। কিন্তু নেতারা মাঠে না নামায় কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। ফলে কর্মসূচি ফ্লপ করছে।’
ওই কমিশনার আরও বলেন, ‘সিনিয়র নেতারা কর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশ দেন। সিনিয়র নেতারা মাঠে থাকলে কর্মীরাও সাহস পায়। কর্মসূচি সফল করতে মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু যেখানে কঠোর কর্মসূচির দিন সিনিয়র নেতাদের মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়, সেখানে কর্মীদের রাজপথে আশা করাটা বোকামি।’
মহানগর বিএনপির এক যুগ্ম-আহ্বায়ক বলেন, ‘দীর্ঘদিন পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়ায় সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী হচ্ছে না। তবে আমরা রাজপথে থাকার চেষ্টা করছি।’ তিনি স্বীকার করেন, যেভাবে আন্দোলন ও কর্মসূচি সফল করা দরকার, তা হচ্ছে না। এ জন্য অতি দ্রুত মহানগরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া উচিত।
সূত্রে জানা গেছে, সরকারবিরোধী আন্দোলনে আশানুরূপ সাফল্য দেখতে না পেয়ে দলের মহানগর কমিটির ওপর ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। চলমান আন্দোলনে ঢাকার বাইরে আন্দোলন ও কর্মকাণ্ড আশা জাগানিয়া হলেও আন্দোলনের মূল স্থান ঢাকা মহানগরের ব্যাপারে চরম হতাশ তিনি। সে কারণে ইদানিং তিনি মহানগর কমিটির ওপর ভরসাও রাখতে পারছেন না। যার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি দলের ৮ নেতাকে ঢাকার ৮টি স্থানে আন্দোলনে নতুন করে সমন্বয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন। নেতাদের প্রতি খালেদা জিয়ার এ দায়িত্ব বণ্টন মহানগর কমিটির প্রতি তার আস্থাহীনতা ও ক্ষুব্ধতারই বহির্প্রকাশ বলে অনেকে মনে করছেন।
সূত্র মতে, সম্প্রতি সরকারি বাধায় পণ্ড হওয়া আলোচিত ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচির ব্যাপারেও খালেদা জিয়া মহানগর কমিটির ওপর ভরসা রাখেননি। এ জন্যই তিনি ঢাকার আশপাশের কয়েক জেলার নেতাদের এ কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ত করতে নির্দেশ দেন।
জানা গেছে, গত ৪ মে শাপলা চত্বরের সমাবেশ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচিই পালন করেনি মহানগর বিএনপি। এরপর থেকে একেবারেই খোলসে ঢুকে গেছে তারা। ৫ মে হেফাজতের সামবেশে সহিংসতার ঘটনায় বিএনপির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অভিযোগ করে সরকার। এ জন্য বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলাও দেওয়া হয়। তারপর থেকে অঘোষিত আত্মগোপনে চলে যান মহানগর আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা। এরপর থেকে দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন তিনি। আত্মগোপনে থেকেই অবশেষে গত বছরের ৫ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর উত্তরার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার হন খোকা।
ঢাকা মহানগর কমিটি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ভালো বলতে পারবেন। তবে ইউনিট হিসেবে ঢাকা মহানগর বিএনপি কাজ করছে। তারা আন্দোলন সংগ্রামে তাদের অংশগ্রহণ অব্যাহত রেখেছে।’
মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আব্দুস সালাম বলেন, ‘আমরা আন্দোলনে আছি। পুলিশ যেভাবে দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর পাখির মতো গুলি চালায় তাতে কীভাবে নেতাকর্মীরা মাঠে নামবেন। পুলিশের সঙ্গে তো আর গোলাগুলি করা সম্ভব নয়।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। আমরা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাস করি।’
আবদুস সালামু বলেন, ‘মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কাজ এগিয়ে চলছে। খুব শিগগিরই এ কমিটি ঘোষণা করা হবে।’
(দ্য রিপোর্ট/টিএস-এমএইচ/এনডিএস/এইচএসএম/এসআই/জানুয়ারি ০১, ২০১৪)