বছর শেষে সব বিষয়ের নয়া-পুরানি হয়। মূল্যায়ন হয় কাজের। রাজনৈতিক অঙ্গনে এ ক্ষেত্রে দলের চেয়ে সরকারের বিষয়েই মানুষের আগ্রহ থাকে বেশি। তবে দলের মূল্যায়নও গুরুত্বের দাবি রাখে। কাগজে কলমে দল এবং সরকার আলাদা বিষয় হলেও দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দুটোই মিলেমিশে একাকার।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দল হিসেবে বিগত পাঁচ বছর কেমন করেছে, এমন প্রশ্নের জবাবে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানালেন অনেকেই। কিন্তু বিগত বছরগুলোতে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যে তার কৌশলে এগিয়ে রয়েছে তা স্বীকার করছেন বিশ্লেষকরা । দলটি যে সব কৌশল ব্যবহার করে নিজেকে শক্তিশালী রেখেছে সে সব কৌশলই আবার প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।

বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন মনে করেন, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ অন্যান্য দলের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে থাকবে। কারণ বাংলাদেশে এই দলটিই মূলত বাংলাদেশের আদর্শের রাজনীতি করে। এটাই আওয়ামী লীগের বড় কৌশল। তাই তারা কৌশলগতভাবে এগিয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

গত পাচঁ বছরের প্রথম থেকেই দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থেকেছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নেওয়া সরকারের পদক্ষেপকে সফলতার সঙ্গে সমর্থন যুগিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির দণ্ডাদেশ কার্যকরের মধ্য দিয়ে গত নির্বাচনের আগে দেওয়া তাদের নির্বাচনী ওয়াদার অনেক বড় একটি সাফল্যের তিলক যুক্ত করেছে।

গত পাঁচ বছরের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু সামনে থাকলেও প্রধান বিরোধী দল তেমন কোনো আন্দোলন দানা বাঁধতে পারেনি। আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের ভাবনা, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী বিধায় বিরোধী দল কোনো আন্দোলনে নিজেদের প্রকাশ করতে পারেনি।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘শেষ ভালোটা হল না। রাজনীতির অনেক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এগিয়ে থাকলেও নির্বাচন নিয়ে নৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকবে।’

২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর পাঁচ বছরের মধ্যে আওয়ামী লীগ দুই বার কাউন্সিল অনুষ্ঠান করতে সমর্থ হয়েছে। যা দলীয় রাজনীতিতে নিয়মতান্ত্রিকতার বহির্প্রকাশ। প্রথম কাউন্সিলে দলে সংস্কারের তকমা নিয়ে কয়েকজন প্রভাবশালী নেতাকে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।

দ্বিতীয় কাউন্সিলে সে সব নেতাকে ফিরিয়ে আনার জোর গুঞ্জন থাকলেও শেখ হাসিনা তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। নীতি নির্ধারণীতে এ সব নেতার অনুপস্থিতিতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বড় ধরনের সংকটে পড়ার আশঙ্কা যারা করেছিলেন তাদের সে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। যদিও সমালোচকদের চোখে দল সরকারে থাকলে সংকট বোঝা না যাওয়ার সমালোচনা রয়েছে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই সবচেয়ে বড় সংকটে পড়ে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ সালে। সরকার গঠনের প্রায় অর্ধশত দিনের মধ্যে এত বড় সংকটে বাংলাদেশের কোনো গণতান্ত্রিক সরকার পড়েনি। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার অপ্রত্যাশিত এ সমস্যা থেকে ঘুরে দাঁড়ায়।

একই বছরের ৮ এপ্রিল মন্ত্রিভার বৈঠকে বেগম খালেদা জিয়ার নামে বরাদ্দ থাকা ক্যান্টনমেন্টের বাসা বাতিল করে সরকার। আইনি ফাঁদে পড়ে বিরোধীদলীয় নেত্রী ৩৮ বছরের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হন। খালেদা জিয়ার চোখের জলে তাৎক্ষণিক কিছু প্রতিক্রিয়া হলেও সরকার ও আওয়ামী লীগের দৃঢ় পদক্ষেপে মাঠে দাঁড়াতে পারেনি বিএনপি।

এর পরের বছরই বহুল আলোচিত পঞ্চদশ সংশোধনীর জন্য বিশেষ কমিটি গঠন করে সরকার। বিশেষ কমিটি গঠন থেকে সংবিধান সংশোধনের চূড়ান্ত সময় পর্যন্ত সরকারবিরোধী দলকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানালে বিএনপি তা প্রত্যাখ্যান করে। আইনি দৃষ্টিতে নিয়ম লঙ্ঘন ছাড়াই সংবিধান সংশোধন করে আওয়ামী লীগ। বিরোধী দলের এ সব দৃশ্য দেখা ছাড়া করার মতো কিছুই ছিল না। বাধাহীনভাবে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পন্ন করে।

সংবিধান সংশোধনের পর থেকেই বিরোধী দল মূলত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে আসছিল। প্রায় সাড়ে তিন বছর একই দাবি নিয়ে মাঠে থাকলেও নতুন কোনো ফর্মূলা দেয়নি তারা। শেষ দিকে যে ফর্মূলা (সাবেক ২০ উপদেষ্টা থেকে সরকার গঠন) দেয় তাতেও সারবস্তু কিছু না থাকায় আওয়ামী লীগের জন্য বরং ইতিবাচক বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আওয়ামী লীগ মানুষকে বোঝাতে চেয়েছে বিরোধী দল নতুন কিছু চায়। কিন্তু কী চায় তারা সেটাই জানে না। একইভাবে সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বার বার বিএনপিকে সংসদে এসে নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে আলোচনার আহ্বান জানানো হয়। শেষ পর্যন্ত বিএনপি সংসদে গিয়ে সেই প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সেখানেও সরকার দলীয়দের কাছে ধরাশয়ী হয় বিএনপি। এ জায়গাতেও কৌশলে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ।

মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের নিয়ে বিএনপির অবস্থান ছিল ধরি মাছ না ছুঁই পানি। এ বিচারকে কেন্দ্র করেও আওয়ামী লীগের কৌশলের কাছে পানি পায়নি বিরোধী দল। বিশেষ করে এ বিচার কার্যক্রমকে কেন্দ্র করে আকস্মিকভাবে জমাট বাঁধা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন মূলত সরকারবিরোধী মনোভাবেই ছিল। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে মোকাবেলা করা হয়। আইন সংশোধনসহ বেশ কিছু পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্ষুব্ধ জনমত বিগড়ে যেতে দেয়নি আওয়ামী লীগ।

বিপরীতে হেফাজতে ইসলামের উত্থান ঘটলেও নরমে-গরমে শক্ত হাতে মোকাবেলা করে তাদের। বিএনপি ও তার শরিকরা হেফাজতকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সমর্থন দিয়ে হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া রাজনীতিকে ঘরে তুলতে চেয়েছিল। শেখ হাসিনার দৃঢ় পদক্ষেপ বিরোধী দলের সেই আশাকেও ব্যর্থ করে দেন।

নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় সংলাপের বদলে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার ফোনালাপ ছিল আলোচনার শীর্ষে। প্রকাশ হওয়া কথপোকথনে শেখ হাসিনার রক্ষণাত্মক বাচন-ভঙ্গির বিপরীতে বেগম খালেদা জিয়ার ক্ষুব্ধ কণ্ঠ শুনেছে দেশবাসী। বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ তাদের হিসেবে লাভের খাতাতেই রেখেছে। তারা মনে করে এতে খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।

সর্বশেষ বেগম খালেদা জিয়ার ডাকা ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি সফল করতে না পারাটাও আওয়ামী লীগ তাদের বিজয় হিসেবে দেখছে।

এভাবে একের পর এক ইস্যুতে নিজেদের অবস্থা সংহত করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। দলটির বিশ্বাস এ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাছে দেওয়া তাদের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের পথ সুগম করবে। ২ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সে ইঙ্গিতই দিয়েছেন।

(দ্য রিপোর্ট/বিকে/এনডিএস/এসআই/জানুয়ারি ০২,২০১৩)