কর্তাভজা
অহংকার কর পরিহার দূর করো জাতির বিচার
দ্য রিপোর্ট ডেস্ক : জয়গুরু সত্য জয়গুরু সত্য/ কর্তাভজা মানে হলো/ জগৎকর্তার ভজন,/ ভেদাভেদ নেই হেথা সত্যের সাধন॥/ সত্য পথে যে জন করে বিচরণ,/ ঈশ্বর তার সাথে রয় সর্বক্ষণ॥/ বেদ বিধি পূঁজা আদি সব রাখ তুলে,/ অন্তরকে খাঁটি কর/ হিংসাকে ভুলে॥/ মন থেকে অহংকার কর পরিহার,/ দূর করে দাও সব জাতির বিচার॥/ সর্ব জীবে কর দয়া ভালবাস সবে,/দুঃখ সব ঘুচে যাবে শান্তিপাবে ভবে॥
এই আলো কর্তাভজার মূল আবেদন।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দর্শনের সন্ধান পাওয়া যায় এ সম্প্রদায়ে। কর্তাভজা সম্প্র্রদায়ে কোনো জাতিভেদ নাই। সকলেই এক রন্ধনশালার পাক গ্রহণ করে। স্পর্শদোষ এদের কাছে মুখ্য নয়। মানুষ হয়ে বর্বতার ভূমিকায় থাকা যাবে না এটিই এদের কাছে মুখ্য বিবেচ্য বিষয়। কর্তাভজা প্রবর্তক আউল চাঁদের নির্দেশ ছিল এ মতাদর্শকে সহজভাবে পালন করতে হবে। আর এ কারণে আউল চাঁদ ফকির প্রবর্তিত ধর্মমতের নাম হলো সহজিয়া ধর্ম, কিন্তু পরবর্তীতে কর্তাবাবা রামসরণ পালের স্থূল দেহের ভজনার সূত্র ধরেই এ সম্প্রদায়ের নামকরণ করা হয় কর্তাভজা। কর্তাভজাদের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো গুরুদেবের পুত্র অযোগ্য হলে তারা তাকে গুরু নির্বাচন করা হয় না। তাদের আইন পুস্তক ভাবের গীতে এ প্রসঙ্গে অভিমত ব্যক্ত করে বলা হয়েছে, কর্তাভজা সম্প্র্রদায়ের সাধন ভজন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান রাখেন এমন ব্যক্তিই গুরুদেব হওয়ার অধিকারী। কর্তাভজা সম্প্র্রদায় বর্ণবাদ এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের কবল থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছে।
কর্তাভজা প্রবর্তক আউল চাঁদের আবির্ভাব দিবসও শুক্রবার। এ কারণে দিনটি এ সম্প্রদায়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ভাষায় শুক্রবারে সৃষ্টির উৎপত্তি হওয়ায় এদিনে তারা মাছ খায় না। প্রকাশ থাকে যে ডিম, মাংস খাওয়া তাদের সম্প্র্রদায়ে নিষিদ্ধ। বহুদেবতার আরাধনা তাদের কাছে শাস্ত্র পরিপন্থী।
কর্তাভজা সম্প্রদায় সমন্বয়বাদী চেতনা লালন করে। এ কারণে মূর্তিপূজা এবং সকল প্রকার আনুষ্ঠানিক যাগযজ্ঞের বিরোধী। মানবসেবাই তাদের কাছে মুখ্য। এ প্রসঙ্গে কর্তাভজা প্রচারক দুলাল চাঁদ রচিত ভাবের গীতে বলা হয়েছে— “আছে মানুষে মানুষে যার ভেদাভেদ জ্ঞান, সে রাজ্য গমনে তার মিলবে না সন্ধান।”
উক্ত ভাবের গীত থেকে বোঝা যায় কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধন ভজনে মানবসেবার প্রসঙ্গটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
এ প্রসঙ্গে ভাবের গীতে আরও বলা হয়েছে—– “মানুষ ভজ, মানুষ চিন, মানুষ কর সার, সকলি মানুষের খেলা মানুষ বই নাই আর।”
এ ধর্মে হিন্দু গুরুর মুসলমান শিষ্য যেমন আছেন তেমনি আছেন মুসলমান গুরুর হিন্দু শিষ্য। গুরুকে এরা মহাশয় এবং শিষ্যকে বরাতি বলে। এ সম্প্রদায়ে নারী পুরুষ নেতৃত্ব নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা হয়না। একারণে গুরুদেবের ভূমিকায় নারী পুরুষ উভয়কেই দেখা যায়। একইভাবে এরা বাউল সম্প্রদায়ের মত জাতিভেদ প্রথা মানেনা। দুলাল চাঁদের ভাবের গীতে তাই আরও বলা হচ্ছে- “ভেদ নাই মানুষে মানুষে, খেদ কেন ভাই এদেশে।”
ফকির আউল চাঁদ প্রসঙ্গ : কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রবর্তক ফকির আউল চাঁদ ১১০১ বঙ্গাব্দে বা ১৬১৬ শকে (১৬৯৪-১৬৯৫) উলা বীর গ্রামে ৮ম বর্ষীয় বালক রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এই দিক থেকে আউল চাঁদ জন্ম গ্রহণ করেন ১০৯৩ বঙ্গাব্দে বা ১৬০৮ শকাব্দে বা ১৬৮৬/৮৭ খ্রিস্টাব্দে। প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী তাঁর মৃত্যু হয় ১১৭৬ বঙ্গাব্দে বা ১৭৬৯ খ্রিঃ বা ১৬৯১ শকাব্দে। রামসরণ পালের সাথে কোন সময় দেখা হয়েছিল সেটি সঠিকভাবে জানা না গেলেও বলা যায় ১৭৬৯ খ্রিষ্টাব্দের কোন এক সময় রামসরণ পালের সাথে আউল চাঁদ ফকিরের সাক্ষাৎ ঘটে এবং কর্তাভজা সম্প্রদায়ের উদ্ভবের প্রেক্ষাপট রচিত হয়। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রচার ও প্রসারে আউল চাঁদের নেতৃত্বে রামসরণ পাল, তার সহধর্মীনি সরস্বতী এবং আরও ২২জন দীক্ষিত ফকির নিরলস ভাবে কাজ করেন।
তবে ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ এর আলোকে বলা হয়, অন্ধকুপ হত্যাকাণ্ডের সময় রামসরণ পালের সাথে ফকির আউল চাঁদের সাক্ষাৎ ঘটে এবং কর্তাভজা ধর্মমত যাত্রা শুরু করে। (প্রপাগান্ডা অনুসারে নবাবের বাহিনী কর্তৃক ইংরেজ সেনাবাহিনীকে অন্ধকার কূপ বা হত্যা সংঘটিত হয় ১৭৫৬ সালের ২০ জুন।) বলা হয়ে থাকে, এ সময় নবাব সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনী কলকাতা অভিযান শেষে মুর্শিদাবাদে ফিরে যাচ্ছিলেন। ফিরে যাওয়ার সময় নবাব বাহিনী আউল চাঁদকে লাঞ্ছিত করেছিলেন। এ সময় আউল চাঁদ অভিশাপ দিয়ে বলেছিলেন এদেশে ফিরিঙ্গী রাজত্ব কায়েম হইবে। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের বিশ্বাস আউল চাঁদের অভিশাপের কারণে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ঘটেছিল এবং বাংলা বিহার উড়িষ্যার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত গিয়েছিল।
নানা নামে গুণ পরিচয় : কর্তাভজা সম্প্রদায়ের বিষয়টি নানা নামে সমাজে বিরাজমান। এগুলো হলো আউলিয়া ধর্ম, সতীমাতার ধর্ম, ঘোষ পাড়ার ধর্ম, সত্য ধর্ম, বা সনাতন ধর্ম, সহজ ধর্ম, এবং কর্তাভজা ধর্ম। কর্তাভজা সম্প্রদায়ের আবার কতকগুলো উপধারা আছে। এ গুলো হচ্ছে ভগবজ্জন, ভগবানিয়া, সাহেব ধনী, রামবল্লভী, বিত্তিহুদা প্রভৃতি।
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রথম দীক্ষিত ব্যক্তির নাম রামসরণ পাল। তাঁর পৈর্তৃক বসত বাড়ি মুর্শিদাবাদ জেলার জগদীশপুর গ্রামে। তাঁর বাবার নাম নন্দরাম পাল। তিনি জাতিতে সদগোপ। তাঁর পেশা ছিল কৃষি। রামসরণ পালের জন্ম তারিখ সম্পর্কে সঠিকভাবে জানা যায় না। তবে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তার জন্ম বলে অনুমান করা যায়। রামসরণ পালের ১ম স্ত্রী গৌরী মারা গেলে তিনি জগদীশপুর (নদীয়া জেলায় অবস্থিত) গ্রামে সরস্বতী দেবীকে বিবাহ করে কল্যাণী থানার ঘোষ পাড়ায় বসবাস করেন। যা হোক রামসরণ পাল আউল চাঁদ কর্তৃক কর্তাবাবা উপাধিতে ভূষিত হন। তার মৃত্যুর পরে এ সম্প্রদায়ীরা সম্প্রদায় বহির্ভূত মানুষ কর্তৃক কর্তাভজা উপাধি প্রাপ্ত হন। কর্তাবাবা রামসরণ পালের অনুসারী হিসেবে তারা এ উপাধি প্রাপ্ত হন।
ভাবের গীত : রামসরণ পুত্র দুলাল চাঁদ কর্তাভজা সম্প্রদায়ের প্রচারক এবং তাদের আইন পুস্তক ভাবের গীতের রচয়িতা। তাঁর মায়ের নাম সরস্বতী দেবী। মাত্র ৭ বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবাকে হারান। তাঁর জন্ম ১৭৭৬ খৃঃ(বাং ১১৮২ সাল ৩রা চৈত্র), মৃত্যু ১৮৩৩ সাল। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ ছিলেন।
দুলাল চাঁদ ১৮৯৩ সালে শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। উপদেষ্টামণ্ডলীর সম্মানিত সদস্যরূপে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি সম্মেলনে যোগদান করতে পারেননি। কারণ সম্মেলন শুরুর অনেক আগেই তিনি মারা গিয়েছিলেন। দুলাল চাঁদ আরবী, ফারসী, ইংরেজি এবং বাংলা ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে মর্যাদার আসনে নিতে তাঁর রচিত ভাবের গীত যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিল। দুলাল চাঁদের ভাবেরগীত বাঙালীর অহংকার।
দুলাল চাঁদের গীত সংখ্যা মতান্তর আছে-
প্রথমত, ১৩০৬ এবং ১৩১৯ বঙ্গাব্দে ভূবনমোহন গঙ্গোপাধ্যায় কর্তৃক প্রকাশিত শ্রী শ্রী যুতের পদের আখ্যা পত্রে মোট সংগীত ৬৫০।
দ্বিতীয়ত, রমেশ চন্দ্র ঘোষ কর্তৃক প্রকাশিত ভাবের গীতের সংগীত সংখ্যা ৬১৬।
তৃতীয়ত, ১৩০০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত ভূবন মোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাবের গীতের সংগীত সংখ্যা ৫৮৫।
চতুর্থত, মনুলাল মিশ্রের (১৩১৩) সম্পাদিত ভাবেরগীতে সংগীত সংখ্যা ৬০১।
পঞ্চমত, মনুলাল মিশ্রের ভাবের গীত (১৩৫৬ পুনঃপ্রকাশ) এর সংগীত সংখ্যা ৫৯০।
ষষ্ঠত, মনুলাল মিশ্রের ভাবেরগীত (১৩৫৬ পুনঃপ্রকাশ) এর সংগীত সংখ্যা ৫৭৩।
সপ্তমত, মনুলার মিশ্রের ভাবেরগীত (১৩৮৪, প্রকাশ) এ সংগীত সংখ্যা ৫৯০।
এ তথ্য উপাত্ত থেকে বোঝা যাচ্ছে দুলাল চাঁদ রচিত ভাবের গীতের সংখ্যা ছয় শতের মত।
এ ধর্মাদর্শ সংগীতের মাধ্যমে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষিত হয়। কর্তাভজা ভগবজ্জনেরা প্রার্থনা সংগীত ছাড়া বাকি সকল প্রকার সংগীত বাদ্যযন্ত্র সহকারে পরিবেশিত হয়। তবে ভগবানিয়ারা বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই সংগীত পরিবেশন এবং তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে অভ্যস্ত। ভগবানিয়ারা যে গীত গায় তার মধ্যে ৩ শতাধিক গীতের রচয়িতা ফকির শিবরাম ঠাকুর। এ জন্য ভগবানিয়ারা কেউ কেউ বলে আমরা শিবরামের অনুসারী।
প্রসঙ্গত, শিবরাম মহন্তের জন্ম স্থান যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার জগদানন্দ কাটী গ্রামে। তিনি ঘোষপাড়ার রামসরণ পালের ১৬০৩২ জন মহাশয়ের একজন হয়ে উঠেছিলেন। আউল চাঁদ প্রাথমিক পর্যায়ে যে ২২ ফকিরকে দীক্ষিত করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন শিশুরাম। কোন কোন কর্তাভজা ভগবানিয়া সদস্যের মতে শিশুরামের বিবর্তিত নাম শিবরাম। সে যাই হোক এ বিষয়টি নিয়ে কর্তাভজা ভগবানিয়া গ্রুপের মধ্যেও রয়েছে অনেক রকম বিতর্ক। বিতর্ক রয়েছে তাদের পরিবেশিত সংগীত বিষয়ে।
সংগীতের প্রকার : ধর্মীয় সংগীতকে মোটামুটি ৭ শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- (১) ভাবে রগীত (২) শিবরামের গীত (৩) সাধু সংগীত (৪) মহাজনী সংগীত (৫) সাহেবধনী সংগীত (৬) রামবল্লভী সংগীত (৭) বিত্তিহুদা সংগীত (রাম দয়াল রচিত)
খাজনা প্রদান : কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ধর্মাচারের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে ‘খাজনা’ প্রদান রেওয়াজ। এটি রাষ্ট্রীয় নিয়মে জমির কর খাজনার সাথে সংশ্লিষ্ট। রাষ্ট্রের জমিতে ফসল ফলানো, ঘর বানানো, প্রভৃতি কারণে সরকারকে খাজনা দিতে হয়। কর্তাভজারাও মালিকের দেহে জীবাত্মা ও পরমাত্মার বসবাসের কারণে তাদের মহাশয় বা সরকার প্রধানের কাছে খাজনা পৌঁছে দেয়। কর্তাভজাদের বিশ্বাস বিনা খাজনায় কারও জায়গায় বসবাস করা যায় না।
পদ্যে বাইশ ফকিরের পরিচয় : এই ধর্মে যে ২২ ফকিরের কথা বর্ণিত হয়েছে তারা হচ্ছে-
শুন সবে ভক্তি ভাবে নাম মালা কথা
২২ ফকিরের নাম ছন্দেতে গাঁথা।
জগদীশ পুর নিবাসী বেচু ঘোষ নাম,
শিশুরাম, কানাই, নিতাই, নিধিরাম।
ছোট ভীম রায়, বড় রামনাথ দাস,
দেদো কৃষ্ণ, গোদাকৃষ্ণ, মনোহর দাস।
খেলারাম, ভোলা, নাড়া, কিনু, ব্রহ্মহরি,
আন্দিরাম, নিত্যানন্দ, বিশু, পাঁচকড়ি।
হটুঘোষ, গোবিন্দ, নয়ন লক্ষ্মীকান্ত,
ইহারাই ভক্তিপ্রেমে অতিশয় শান্ত।
এছাড়াও আরও কয়েক জনের নাম প্রখ্যাত হিসেবে জানা যায়। এরা হলেন নফর বিশ্বাস, সরাফ মোল্লা এবং শিব রাম মহন্ত। শিবরাম মহন্ত সম্পর্কে আগেই আলোচনা করা হয়েছে। এখন নফর বিশ্বাস ও সরাফ মোল্লার প্রসঙ্গে আসি। নফর বিশ্বাসের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া থানার বোয়ালিয়া গ্রামে। এইখানে আউল চাঁদ ফকিরের কাঁথার সমাধি আছে। আউল চাঁদ ফকির ছিলেন জটাধারী এবং তিনি কাঁথা পরিধান করতেন। এ নিয়ে যে মতান্তর রয়েছে তা হচ্ছে, পশ্চিম বঙ্গের শাকদহ সংলগ্ন বোয়ালিয়াতেই আউল চাঁদ ফকিরের কাঁথার সমাধি আছে।
নফর বিশ্বাস পরবর্তীতে আউল চাঁদের অনুকরণে ফকির উপাধি লাভ করেন। আর সেই থেকে তারা অর্থাৎ তার বংশ ধর ফকির উপাধিতে ভূষিত হয় এবং তার বাড়ী সংলগ্ন চার রাস্তার মোড়টি ফকিরপাড়ার মোড় হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছে এবং সেখানে একটি বাজারও গড়ে উঠেছে।
নবজাতকের নাম নির্বাচন : নাম নির্বাচনে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মধ্যে ধর্ম নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান। নবজাতকের নামকরণে হিন্দু মুসলমান সব রকমের নাম রাখার প্রবণতা কর্তাভজাদের মধ্যে রয়েছে। মায়ের নাম শারমিন নাহার মেয়ের নাম তপতী বালা এতে কোন আপত্তি নেই কর্তাভজা সম্প্রদায়ে। বাবার নাম শওকত মোড়ল, ছেলের নাম সুশান্ত। এতেও কেউ কোন আপত্তি করেনা। মৃতদেহ গোসল দিয়ে কাফন পরিয়ে দাফন করছে, আবার কেউ কেউ শ্মশানে নিয়ে দাহ করছে। বিবাহিত মহিলাদের অনেকে শাখা সিঁধুর পরে আবার অনেকে পরেনা। কর্তাভজা সম্প্রদায়ে যোগ সাধনায় গুরুত্বারোপ করা হয়। যোগ উপবাসে এরা বিশ্বাসী নয়। সহজাত প্রবৃত্তিকে সহজভাবে পরিচালনা করাই তাদের কাছে রেওয়াজ। এক কথায় বলা যায় কর্তাভজা সম্প্রদায় শাস্ত্রাচার এবং বেদ বিরোধী। তথাকথিত শাস্ত্রে এদের কোন ভক্তি শ্রদ্ধা নেই। বেদের বিধানেও এরা বিশ্বাসী নয়। তথাকথিত জাতিবর্ণ প্রথা এরা মানেনা।
উৎসব প্রসঙ্গ : কর্তাভজা সম্প্রদায়ের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো- এরা ‘লোকমধ্যে লোকাচার এবং সদ গুরুর মাঝে একাচার’ এ নীতিতে বিশ্বাসী। এ কারণে এ সম্প্রদায়ীরা আবহমান বাংলায় প্রচলিত ঈদুলফিতর, ঈদুল আযহা, দুর্গোৎসব, জন্মাষ্টমী, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, বড়দিন সব উৎসব আয়োজনে আনন্দ ভাগাভাগি করে। এছাড়াও রয়েছে তাদের নিজস্ব উৎসব অনুষ্ঠান যেমন রথ, উৎসব, দোল উৎসব এবং ভগবানিয়াদের মাসিক উৎসবে অংশ নেয়। কর্তাভজা ভগবানিয়াদের দু’টি উল্লেখযোগ্য বড় উৎসব হলো চৈত্র মাসের মহোৎসব এবং কার্তিক মাসে শিবরাম মহন্তের বসতবাটীতে রাশ পূর্ণিমার উৎসব। এছাড়া প্রতি বছর অঘ্রায়ণ মাসের শেষ দিনে ফকির আউল চাঁদ স্মরণে তাঁর কাঁথার সমাধি স্থল বোয়ালিয়াতে উৎসব হয়। তবে একটি কথা সুস্পষ্ট যে কর্তাভজা সম্প্রদায়ভুক্ত কোন উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত লোকজন বহুদেবতায় বিশ্বাস করেনা। বহুদেবতার আরাধনা তাদের কাছে শাস্ত্র পরিপন্থী।
যথা আজ্ঞা দশ : ধর্মে দশ আজ্ঞা বা হুকুম পালন করতে হয়। এগুলো হচ্ছে-
(১) সদা সত্য কথা বলা
(২) হিংসা না করা (কাউকে বধ করাও হিংসার অন্তর্ভুক্ত)
(৩) চুরি না করা
(৪) ডিম, মাংস না খাওয়া
(৫) কখনও মিথ্যা কথা না বলা
(৬) উচ্ছিষ্ট না খাওয়া
(৭) পরস্ত্রী বা পর পুরুষে আসক্ত না হওয়া
(৮) মাদক দ্রব্য বর্জন করা
(৯) ধর্মীয় অনুষ্ঠানে তামাক সেবন না করা
(১০) পিতা, মাতা, গুরুজন এবং প্রতিবেশীর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা।
কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সদস্যদের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারিত কোন পোষাক বরাদ্দ নেই। ‘আপন সাধন ভজন কথা না কহিবে যথা তথা’ এ নিয়মের কারণে বলা যায় কর্তাভজারা সহজিয়া গুরুবাদে বিশ্বাস করে। তারা তান্ত্রিক এবং ভেষজ চিকিৎসা জগতকেও খুব গুরুত্ব দেয়। অসুখ বিসুখে ডাক্তারের চিকিৎসা অপেক্ষা কবিরাজী এবং আযুর্বেদীয় চিকিৎসাকে পছন্দ করছে বেশী। সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি এমনকি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও গাছের লতা-পাতা শেকড়, বাকলের প্রতি তাদের গুরুত্ব বেশি।
কর্তাভজা একটি মানবতাবাদী চেতনা। তাদের মূল কথা “বেদ বিধি পূজা আদি সব রাখ তুলে, অন্তরকে খাঁটি কর হিংসাকে ভুলে।”
(দ্য রিপোর্ট/একেএম/জানুয়ারি ০৩, ২০১৪)