রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুতবা
ইসলামের সাম্য ও ন্যায়বিচার
এ কে এম মহিউদ্দীন : আলোর পথ প্রদর্শক মহানবী(সা.) উম্মাতের জন্য পদে পদে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। তাঁর প্রতিটি কর্ম মানবতাকে উচ্চকিত করেছে। মানুষের জন্য সাম্যভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে নিরন্তর চেষ্টা চালিয়েছেন। এটা নির্জলাসত্য তিনি ছিলেন ন্যায়বিচারক। আজ আমরা তাঁর এরকমই একটি দৃষ্টান্ত পেশ করছি যা প্রমাণ করে তিনি যথার্থই মানবতার বন্ধু ছিলেন।
বনী মাখ্যুম গোত্রের একজন সম্মানিত মহিলা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। ইসলামী আইন অনুযায়ী চুরির শাস্তি হাতকাটা। এই শাস্তিটি যেমন কষ্টদায়ক, তেমনি অভিশপ্তও। এ কারণে ওই গোত্রের লোকেরা এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) এর কাছে সুপারিশ করার জন্য একের পর এক হজরত আবু বকর, উমার, উসমান ও আলী ইবন আবু তালিব (রা.)-এর কাছে আসে। কিন্তু নবুওয়াতের প্রবল পরাক্রমকে উপেক্ষা করা এদের কারো পক্ষেই সহজ ব্যাপার ছিল না। তাই তারা সুপারিশ করতে অস্বীকার করে। তবে শেষাবধি ওই গোত্রের লোকেরা উসামা ইবন যায়দ (রা.)এর কাছে আসে। কারণ উসামা (রা.) ছিলেন হুজুর (সা.) এর আজাদকৃত গোলাম হজরত যায়দ (রা.) এর পুত্র। ইসলামের ইতিহাসে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা.) তাঁকে এমনভাবে প্রতিপালন করেছিলেন যে, তিনি তার এক উরুতে তাকে এবং অন্য উরুতে হজরত ইমাম হাসান (রা.) কে বসাতেন এবং বলতেন, ইয়া আল্লাহ, আমি এ দুজনকে ভালবাসি, তুমি এদেরকে ভালবাস। উসাম ইবন যায়দ (রা.) তখনও যুবক, তাই তিনি ওদের অনুরোধ কবুল করে রাসূলের (সা.)দরবারে সুপারিশ করেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মহানবী একটি গুরুত্বপূর্ণ খুতবা পেশ করেন। এখানেই প্রতিফলিত হয়েছে ইসলামের সাম্য ও ন্যায়বিচারের বিষয়টি সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে। মহান রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা ও প্রশস্তি বর্ণনার পর মহানবী (সা.) বলেন, হে মানুষ, অতীত যুগের মানুষকে শুধু এ জন্য ধ্বংস করা হয়েছে যে, তাদের মধ্যকার অভিজাত লোকেরা যখন কোন অপরাধ করত তখন তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হত, আর যখন সাধারণ লোকেরা অপরাধ করত, তখন তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হত। কসম সেই সত্তার যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ, যদি মুহাম্মদের কন্যা ফাতিমাও চুরি করত তাহলে তারও হাত কাটা যেত। [ইবন মাজা]
মুহাদ্দিসরা এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, রাসূলের (সা.) এই ভাষণ ইসলামের সেই অতুলনীয় সাম্য ন্যায় বিচারের স্বরূপ সর্ব সমক্ষে তুলে ধরেছে, যার অনবদ্যতা ইসলামের কট্টর শত্রুরাও স্বীকার না করে পারবে না। রাসূল (সা.) এর পর তাদের খলিফাগণও একই শিক্ষায় দীক্ষা নিয়েছিলেন। হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) তার গভর্নরদেরকে নির্দেশ দিতেন, তোমরা অবশ্যই ন্যায় বিচার করবে, জুলুম-অত্যাচার থেকে দূরে থাকবে, কোন অঙ্গীকার করলে কখনো তার বরখেলাপ করবে না এবং সন্ধি করলে কখনো ভঙ্গ করবে না। হজরত আলী ইবন আবু তালিব (রা.) বলেন, আদল বা ন্যায় বিচারের একটি মাত্র রূপ এবং জুলুমের অনেক রূপ। তাই অপরাধ করা সহজ এবং ন্যায়বিচার করা কঠিন। হজরত উমার ইবনে আব্দুল আজীজ (রা.) তাঁর একজন গভর্নরকে লিখেন, তোমার ক্ষমতা তোমাকে মানুষের উপর জুলুম করার সুযোগ দিলেও তোমার মুকাবিলায় আল্লাহ্র যে অসীম ক্ষমতা রয়েছে সে কথাটুকু ভুলে যেয়ো না।
এরিস্টটল আলেকজান্ডারকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তোমার কাছে কোন জিনিসটি সব চাইতে প্রভাশালী, বীরত্ব না ন্যায় বিচার? যোগ্য শিষ্যের মতই উত্তর করেছিলেন সম্রাট আলেকজান্ডার, যখন আমি ন্যায় বিচারকে কার্যকর করি তখন বীরত্বের কোন প্রভাব এর উপর থাকে না। কোন কোন আইনবেত্তার মতে, ন্যায় বিচার দ্বারা বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। ন্যায় বিচার হচ্ছে সেই নিক্তি বা পাল্লা, যা মহান আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন তার সৃষ্টির জন্য এবং সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য স্থাপন করেছেন। অতএব তোমরা আল্লাহ্র নীতি তারই স্থাপিত পাল্লাতে ভঙ্গ করো না এবং তার রাজত্বে তার সমকক্ষ হওয়ার চেষ্টা করো না। আরবী একটি কিতাবে বর্ণিত হয়েছে, ন্যায় বিচার হচ্ছে শাসকদের দেহে মৌলিক উপাদান বিশেষ। দেহ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও এই মৌলিক উপাদান বাকি থাকে। আরও বলা হচ্ছে, ন্যায় বিচার হচ্ছে একটি প্রাণ, যার দ্বারা রাজ্য জীবন লাভ করে, আর জুলুম অত্যাচার হচ্ছে একটি ধ্বংসকারী বস্তু, যার দ্বারা রাজ্য ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। আরেকটি মত নীতিশাস্ত্রে বর্ণিত হয়েছে, এমন কোন হাত নেই, যার উপর আল্লাহ্র হাত জয়ী হতে পারে না, আর এমন কোন জালিম নেই, যে অন্য জালিমের ফাঁদে পড়বে না। একজন পণ্ডিত উপদেশ দিয়ে বলছেন, হে কাজী ও বিচারকগণ, তোমরা রায় দান করার সময় ন্যায় বিচারের প্রতি লক্ষ্য রাখো। কেননা ন্যায় বিচারই হচ্ছে মানুষের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট নীতি। যদি তোমরা ন্যায়ের সঙ্গে ফয়সালা কর তাহলে স্বস্তি পাবে এবং আপন খাটিয়ার উপর আরামে ঘুমাতে পারবে।
একবার দ্বিতীয় উমর বলে খ্যাত উমর ইবন আব্দুল আজীজ (রা.) এর জনৈক গভর্নর শহরের বেষ্টনী প্রাচীর তৈরির জন্য তাঁর অনুমতি প্রার্থনা করেন তখন উমর ইবন আব্দুল আজীজ (রা.) তার কাছে লিখেন, এটা করার দরকার নেই, বরং শহরটাকে ন্যায়বিচার দ্বারা মজবুত ও সুদৃঢ় এবং এর রাস্তাসমূহকে জুলুম-অত্যাচার থেকে মুক্ত কর। আব্দুল্লাহ্ ইবন জাহির একদা তার আব্বাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমাদের এই রাজত্ব আর কতদিন বাকি থাকবে? তিনি উত্তর দিলেন, যতদিন এর বিচারালয় ন্যায়বিচার দ্বারা ঢাকা থাকবে।
প্রিয় পাঠক, ইসলাম হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থার নাম যেখানে একই সূত্রে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনকে একই সূত্রে গেঁথে রেখেছে। ইসলাম একদিকে স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক সমুন্নত করে, অন্যদিকে সৃষ্টির সঙ্গে সৃষ্টির সম্পর্ক অটুট অব্যাহত রাখে। মানুষের এই দ্বিবিধ সম্পর্কের পরিগঠন ও পরিশীলনের জন্য ইসলামী শরীয়াতে যে সকল নিয়ম-কানুন ও নীতিমালা বিধৃত হয়েছে, তাই হচ্ছে ইসলামী আইন। এই আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা করা, প্রত্যেকের প্রাপ্য অধিকার ভোগ নিশ্চিত করা, অনধিকার চর্চা থেকে বিরত রাখা এবং কর্তব্য পালনে ও দায় বহনে বাধ্য করা। আমরা এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম যে, ন্যায় বিচারের ক্ষেত্রে মহানবী প্রকৃত পক্ষেই একটি দৃষ্টান্ত। আর এ দৃষ্টান্ত স্থাপনে ইসলামের খলিফাগণ বরাবরই আল্লাহ্র রাসূলের নীতি কবুল করে নিয়েছেন। হজরত আলীর (রা.) শাসন আমলে বিচার বিভাগ শাসন বিভাগ থেকে পৃথক রাষ্ট্রের একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন বিভাগ হিসেবে বিকাশ লাভ করে। মহানবী (সা.) খুলাফায়ে রাশেদীন এবং পরবর্তী শাসকগণের আমলে রাষ্ট্রীয় সংগঠন প্রধানত তিনটি বিভাগে বিভক্ত ছিল। শাসন বিভাগ, সামরিক বিভাগ ও বিচার বিভাগ। পরবর্তীকালে সামরিক বিভাগের জন্য স্বতন্ত্র বিচারক নিয়োগ করা হয়। সেকালে নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত বর্তমানের মত এতগুলো স্তর ছিল না। খলিফা হারুনুর রশিদ একটি সর্বোচ্চ আদালত স্থাপন করেন এবং উক্ত আদালতের বিচারকের জন্য (প্রধান বিচারপতি) কাজীল কুজাত পদবী প্রচলন করেন। মানবজাতির বিচার ব্যবস্থার ইতিহাসে মুসলমানগণই এভাবে সর্বপ্রথম সর্বোচ্চ আদালত স্থাপন করেন।
লেখক: সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক ও পিএইচডি গবেষক