সোহেল রহমান, দ্য রিপোর্ট : ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের আমলে দেশে কোটিপতির সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। সরকারের সাড়ে চার বছরে (জানুয়ারি ২০০৯-জুন ২০১৩) দেশে প্রায় ২৭ হাজার নব্য কোটিপতির উত্থান ঘটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার যখন (জানুয়ারি ২০০৯) ক্ষমতায় আসে তখন দেশে মোট কোটিপতির সংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ১৬৩ জন। ২০১৩ সালের জুন শেষে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ১৩৫ জনে। অর্থাৎ মহাজোট সরকারের সাড়ে চার বছরে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ।

ইতোপূর্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার আগে দু’বছরের (২০০৭-০৮) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ৫ হাজার ১১৪ জন এবং এরও আগে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে (অক্টোবর ২০০১-ডিসেম্বর ২০০৬) কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছিল ৮ হাজার ৮৮৭ জন।

এদিকে মহাজোট সরকারের আমলে এ বিপুল সংখ্যক কোটিপতির উত্থানের বিষয়টি স্বাভাবিক বলেই মন্তব্য করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দু’জন সাবেক শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা।

সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ইট ইজ নট ব্যাড সাইন। কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, শিল্পায়ন বেড়েছে। তবে কারা এ সব বিত্তের মালিক হচ্ছেন এবং এর ফলে অসাম্য বাড়ছে কি না-এ সব নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।’

সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ দ্য রিপোর্টকে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। দেখা যাবে, আগামীতে যে সরকার আসবে তখন এ সংখ্যা আরও বাড়বে এবং এটা বাড়তেই থাকবে, কমবে না।’

তিনি বলেন, ‘সরকার যেটা করতে পারে সেটা হচ্ছে, এ সংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে রাখা এবং যে বৈষম্য বাড়ছে সেটা কমিয়ে আনা। কিন্তু এর জন্য যে কমিটমেন্ট থাকা দরকার সেটা কোনো রাজনৈতিক দলের মধ্যে দেখছি না।’

তবে এদের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাত। তার মতে, ‘বাংলাদেশে বৈধ পথে কোটিপতি হওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। লুটতরাজই আমাদের দেশে কোটিপতি হওয়ার প্রধান পদ্ধতি। বাংলাদেশে কোটিপতিদের আদি সঞ্চয়নও হয়েছে অবৈধ পথে, কালো টাকার মাধ্যমে।’

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সব তফসিলি ব্যাংকের কাছ থেকে প্রাপ্ত হিসাবের ভিত্তিতে যে প্রতিবেদন তৈরি করে সেটাই কোটিপতির সংখ্যা নির্ধারণের নির্ভরযোগ্য ভিত্তি। তবে এটা শুধু বৈধ বা রেকর্ডেড কোটিপতির সংখ্যা। আন-রেকর্ডেড বা অবৈধ কোটিপতির সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশে গত চার দশকে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধির চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রতিবার ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে দুই থেকে তিনগুণ। অন্যদিকে আশির দশক পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে মাঝারি ও ক্ষুদ্র আমানতকারীদের একটা বিশেষ অবস্থান ছিল। গত নব্বইয়ের দশক থেকে ব্যাংকগুলোতে কোটিপতি আমানতকারীদের আধিপত্য বাড়তে থাকে।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ছিল মাত্র ৫ জন। শেখ মুজিবুর রহমান (ডিসেম্বর ১৯৭৫) ও জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে (ডিসেম্বর ১৯৮০) এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪৭ ও ৯৮ জনে। সে সময়ে তাদের আমানতের পরিমাণ ছিল ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের ১০ শতাংশ। এরশাদ সরকারের পতনের সময় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪৩ জন ও আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ শতাংশ। এই ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে ১৯৯৬ সালের জুনে কোটিপতির মোট সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫৯৪ জন ও আমানতের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ২০ শতাংশ। পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার প্রথম শাসনামলে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর শেষে কোটিপতির মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ১৬২ জন ও আমানতের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ২২ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের গত ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের ব্যাংকিং খাতে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে মোট ৪৬ হাজার ১৩৫ জন। এটা ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতকারীর মাত্র দশমিক ০৭ শতাংশ। অন্যদিকে তাদের মোট আমানতের পরিমাণ হচ্ছে ২ লাখ ২৫ হাজার ৩৬৮ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। যা ব্যাংকিং খাতের মোট আমানতের প্রায় ৪০ শতাংশ।

কোটিপতি হওয়ার ফর্মূলা শ্রেণী চরিত্র

বাংলাদেশে কোটিপতিদের শ্রেণী চরিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে দুই ধরনের ধনী রয়েছেন। এদের একটি অংশকে বলা হয় ‘বনেদী’আর অন্যটি হচ্ছে ‘নব্য’। এই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সময়ের পার্থক্য ছাড়া তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখল করে বনেদীদের যাত্রা শুরু হয়। অন্যদিকে নব্যরা তাদের যাত্রা শুরু করে স্বাধীনতার পর পাকিস্তানীদের সম্পত্তি দখল করে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ কোটিপতিদের উত্থান প্রসঙ্গে বলেন, ‘স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশে যে ধরনের অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করা হয়েছিল সেটা ছিল ওয়েলফেয়ার ইকোনমি। কিন্তু ১৯৭৫ এর পর সেটা হয়ে গেছে পুঁজিবাদী অর্থনীতি। আর পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে টাকা কামানোটাই বড় কথা। লুটপাট, চুরি এগুলো কোনো বিষয় নয়। তবে আগে এগুলো অতটা ডাই-হার্ট ছিল না, এখন যতটা হয়েছে। তবে পুঁজি বিকাশের ফলে প্রচুর উন্নতি হয়েছে। এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে।’

স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশে বিত্তবান হওয়ার যে প্রক্রিয়া এখানে চালু হয়, কেউ কেউ এটাকে তুলনা করেন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির পুঁজি সংগ্রহের প্রক্রিয়ার সঙ্গে। এই প্রক্রিয়া হচ্ছে ব্যাপক লুণ্ঠনের মাধ্যমে সম্পদ আহরণ। পশ্চিমাদের ফেলে যাওয়া শিল্প প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, বীমা ও সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে এগুলো পরিচালনার দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়েছিল, তারা ওইসব প্রতিষ্ঠানের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও লাইসেন্স ইত্যাদি বিক্রি করে প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করলেও নিজেরা হয়েছেন কোটিপতি। একই সঙ্গে ব্যাপক চোরাচালান, মজুতদারী, লাইসেন্স পারমিট ব্যবসা এবং ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষ ছিল কোটিপতিদের উত্থানের একটি স্বর্ণ কাল।

পঁচাত্তরের পর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে জনগণের সঞ্চয় এবং বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য কতিপয় গোষ্ঠীর মধ্যে বিতরণের জন্য ব্যাংকের দরজা খুলে দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় আশি ও নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত ঋণ খেলাপী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা উঠে আসেন কোটিপতির তালিকায়।

দেখা যায়, শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা তাদের শিল্পে যে বিনিয়োগ করেছেন, ব্যাংকে তাদের দেনার পরিমাণ তার চেয়েও অনেক বেশি। অর্থাৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কাছে যে যত বেশি ঋণী, সে তত বড় কোটিপতি। এর সঙ্গে নব্বইয়ের দশকে জমি কেনা- বেচা, হাউজিং ও গার্মেন্টস ব্যবসায়ী, চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী, নির্মাণ কাজের ঠিকাদাররা কোটিপতির তালিকায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেন।

এ ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে পেশাজীবীদের মধ্যে উকিল ও ডাক্তারদের অনেকে কোটিপতির তালিকায় রয়েছেন। এর বাইরে মাস্তানী, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি করে টোকাই থেকে কোটিপতি হয়েছেন এমন উদাহরণও রয়েছে।

তবে বলাবাহল্য, স্বাধীনতোত্তর বাংলাদেশের শুরু থেকে এখন পযর্ন্ত প্রতিটি পর্বেই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে আমলা, প্রশাসক এমন কী মন্ত্রীরাও এই প্রক্রিয়ার অন্তর্গত।

(দ্য রিপোর্ট/এসআর/এনডিএস/এইচএসএম/জানুয়ারি ০৩, ২০১৪)